প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে মানুষের আগ্রহ থাকে না

সম্পাদকীয়

নির্বাচনের ৩৬ ঘণ্টা আগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন। অনেকের মনেই ভোটের দিন নিয়ে শঙ্কা ছিল। শেষ পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তেমন কোনো সহিংসতা ছাড়া। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির হরতাল ও নির্বাচন বর্জনের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেও তেমন বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি।

তবে ভোটের আমেজ বা উৎসব বলতে যা বোঝায়, এই নির্বাচনে তা দেখা যায়নি। ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার যে চিরাচরিত ছবি, সেই ছবি ছিল মোটের ওপর অনুপস্থিত।

প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনটি একদিকে যেমন অংশগ্রহণমূলক হয়নি, তেমনি খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সরকারি দল জনগণের অংশগ্রহণকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শর্ত হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলেছিল। সরকারি দলের মূল চ্যালেঞ্জ ও চেষ্টা ছিল ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা, কিন্তু সেই উদ্যোগ খুব সফল হয়েছে বলা যাবে না।

নির্বাচন কমিশন বেলা তিনটার দিকে বলেছিল, সারা দেশে ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে ভোট গ্রহণ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ভোট পড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ভোটকেন্দ্রগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সকালের দিকে সিইসি নিজেই বলেছেন, তিনি ভোটকেন্দ্রগুলোয় শুধু নৌকার প্রার্থীর পোলিং এজেন্টই দেখেছেন। প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা যেসব আসন ঘুরে দেখেছেন, সেখানেও ছিল একই হাল।

সেই অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন না হলেও কোথাও কোথাও ভোট কারচুপির চেষ্টা হয়েছে। নরসিংদী-৪ আসনের একটি কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকে সিল মারার অভিযোগ উঠেছে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছেলের বিরুদ্ধে। ভোটের একেবারে শেষ পর্যায়ে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। চট্টগ্রাম-১০ আসনে এক যুবককে প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।

মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনে ভোটকেন্দ্রের পাশে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাসের এক সমর্থককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামীম হকের সমর্থকদের বিরুদ্ধে একটি ভোটকেন্দ্র দখল করে নৌকায় সিল মারার অভিযোগ উঠেছে। সেখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ। ভোটে নানা অনিয়ম ও জবরদস্তির অভিযোগ এনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ৩০ জন। তবে নির্বাচন কমিশন কিছু ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছে।

এই নির্বাচন কতগুলো সত্য আমাদের সামনে হাজির করেছে। প্রথমত, সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলে সেই নির্বাচনে জনগণের আগ্রহ থাকে না। এমন নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতিফলনও ঘটে না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিছক ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির হয় না। সেখানে নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গতকালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। এমনকি জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দলও নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে। আসলে নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ-নির্ভর দলগুলোর মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনের ফলাফল ছিল সবারই জানা।

এই নির্বাচন হয়তো সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতার সংকট থেকে যাবে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এই গ্রহণযোগ্যতার সংকট সামনে নানা প্রতিকূলতা তৈরি করতে পারে। বর্তমান সরকার নতুন করে আবার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি সামাল দেওয়া, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মতো কাজগুলো তারা কীভাবে করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।