অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার (গত ৮ আগস্ট) পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি; বরং মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলেছে। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষ। এ কারণেই সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কম দামের পণ্যের ট্রাকের পেছনে ক্রেতাদের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। আগে কেবল গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষ টিসিবির ভোগ্যপণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়াতেন। এখন নিম্নমধ্যবিত্ত নারী–পুরুষেরাও দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাতে প্রথম আলো নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। খবর অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। গত নভেম্বরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে।
মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বাজারে একেক সময় একেকটি পণ্যের ঘাটতি তৈরি হওয়াও ভোক্তাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক দিনে বেশি দাম দিয়েও বোতলজাত ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না। এর পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে কি না, তা অবিলম্বে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান যা বলেছেন, তা আরও বিপজ্জনক। তাঁর মতে, বিবিএস যে পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি গণনা করে, তাতে গরিব মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ কতটা অনুভব করেন, তা ঠিকমতো উঠে আসে না। জাতীয় গড় হিসাবে মূল্যস্ফীতির হিসাব আসে। একটি পরিবারকে গড়ে তাদের আয়ের ৪৮ শতাংশ অর্থই খাবার কেনার পেছনে খরচ করতে হয়। অন্যদিকে খাবার কিনতে গরিব পরিবারকে আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মতো অর্থ খরচ করতে হয়।
বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গ্রামের চেয়ে বেশি। নভেম্বর মাসের হিসাবে, শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে। আর গ্রামে এই হার ১৩ দশমিক ৪১। গ্রামের ভোক্তারা অনেক কিছু নিজে উৎপাদন করেন বলে সেখানে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কম। শহরে মানুষকে সব পণ্য কিনে খেতে হয়। তবে আয়ের বিষয়টি আমলে নিলে তাঁদের ওপরও চাপ কম পড়ে না।
কঠিন বাস্তবতা হলো ভোগ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়লেও মানুষের আয় বাড়ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিতেও স্থবিরতা চলছে। পণ্য আমদানিও কমছে। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ভোক্তাদের চাহিদার চেয়ে কম খাবার কিনে খেতে হচ্ছে অথবা সংসারের অন্যান্য খাতের ব্যয় কমিয়ে খাবার কিনতে হচ্ছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে এত দিন সরকার রুটিনমাফিক তদারকি ও নজরদারি করে আসছিল, যা তেমন কাজে লাগেনি। ভোক্তা অধিকার দপ্তরের ঝটিকা তল্লাশি অভিযান অনেকটা চোর–পুলিশ খেলায় রূপ নিয়েছে। আমরা মনে করি, খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সরকারকে আরও শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়মিত বাজার তদারকির পাশাপাশি বিকল্প উপায় পণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। শুল্ক কমানো কিংবা পুরোপুরি প্রত্যাহারের পরও কাদের কারসাজিতে আমদানি পণ্যের দাম কমছে না, সেটা খতিয়ে দেখার দায়িত্বও সরকারের। আর তিন মাস পরই পবিত্র রমজান মাস। সেই সময়ে ভোগ্যপণ্যের দাম যাতে কোনোভাবেই না বাড়ে, সরকারকে আগে থেকেই তার জন্য বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।