রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগে ‘সবলা’ কবিতায় প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘নারীকে আপন ভাগ্য গড়ে তুলিবার কেন নাহি দেবে অধিকার?’ সেটি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনামল। ঔপনিবেশিক শাসকেরা অনেক আগেই দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। এরপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, তাতে নারী–পুরুষ উভয়ের অবদান আছে। কিন্তু নারীর আপন ভাগ্য গড়ে তোলার অধিকার এখনো অধরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০০৪, ২০১১ ও ২০২৩ সালের আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপের তথ্য অনুসারে, গত দুই দশকে নারীপ্রধান পরিবারের হার বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৪ সালে আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপে দেশে পুরুষপ্রধান পরিবারের হার ছিল প্রায় ৯২। নারীপ্রধান পরিবারের হার প্রায় ৮।
আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩ অনুসারে পুরুষপ্রধান পরিবারের হার প্রায় ৮৫ এবং নারীপ্রধান পরিবারের হার প্রায় ১৫।
বিবিএসের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদনে অবশ্য নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা কিছুটা বেশি। ২০২২ সালে ছিল ১৭ শতাংশ। বর্তমান ধারা বজায় থাকলে ২০৩০ সালের দিকে নারীপ্রধান পরিবার ২৫ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।
যেখানে নারী-পুরুষ মিলেই সমাজ ও পরিবার, সেখানে পুরুষপ্রধান ও নারীপ্রধান বিভাজনরেখা টানা সমীচীন বলে মনে করি না। তারপরও বিবিএস যেসব ধারণা ও তথ্যের ভিত্তিতে নারীপ্রধান পরিবারের হার বেড়েছে বলে সিদ্ধান্তে এসেছে, সেটাও গোলমেলে। অনেক সময় স্বামীর মৃত্যু, অসুস্থতা কিংবা বিবাহবিচ্ছেদের কারণে নারীকে পরিবারের হাল ধরতে হয়, সেটা ঠিক আছে। স্বামীর মৃত্যু কিংবা বিবাহবিচ্ছেদের পর নারীর কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার দৃষ্টান্তও কম নয়। জরিপে নারীপ্রধান পরিবারের হার বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে পুরুষের বিদেশে থাকার কথা বলা হয়েছে। এসব পরিবারের ব্যবস্থাপনায় নারীর ভূমিকা মুখ্য হলেও অর্থ খরচের বিষয়ে তাঁরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এমনকি সন্তানদের শিক্ষা ও বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন প্রবাসী পুরুষ অথবা তাঁর অন্য স্বজনেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, একা জীবন যাপন করা, পরিবারকে সাহায্য করার মতো সক্ষমতা তৈরি হওয়া এবং নির্যাতনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ককে ধরে না রেখে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রবণতা বাড়ার কারণেও নারীপ্রধান পরিবার বাড়ছে। নারীদের মধ্যে স্বনির্ভর হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে; কিন্তু পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে তাঁরা তেমন সহযোগিতা পান না। ঘরে–বাইরে নানা বাধার মুখোমুখি হতে হয়।
নারীপ্রধান পরিবারের অর্থ হলো, সব বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকা। পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রে যেমন সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে, আবার সঠিকও হতে পারে। কিন্তু নারীর সিদ্ধান্ত ভুল হলে সমাজ যেভাবে শোরগোল তোলে, পুরুষের ক্ষেত্রে সেটা দেখা যায় না। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এটাও বড় বাধা বলে মনে করি।
আশার কথা, সমাজের মধ্য ও ওপরের স্তরের চেয়ে নিম্নস্তরের পরিবারে নারীর অধিকার ও অংশীদারত্ব বেড়েছে। এর কারণ এসব পরিবার কেবল পুরুষের আয়ে সংসার চলে না; নারীকেও সহায়তা করতে হয়। নারী যত বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবেন, পরিবার ও সমাজে তাঁর অংশীদারত্বও তত বাড়বে।