শাসক যত ক্ষমতাধরই হোন না কেন, জনগণের ইচ্ছার বিপরীতে গিয়ে যে টিকতে পারেন না এবং করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়, সিরিয়ায় সেটাই প্রমাণিত হলো। সিরিয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠী তাহরির আল-শাম ও অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন ঘটল। এই ঘটনা গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশ সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কথা মনে করিয়ে দেয়।
১৯৬৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭১ সালে বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদ পার্টির ভেতরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আমিন আল-হাফিজের কাছ থেকে ক্ষমতা নেন। হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন ২০০০ সালে। বাশার শুরুতে কিছু জনকল্যাণমূলক কাজ করলেও তাঁর ক্ষমতার ভিত্তি ছিল রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর নিষ্ঠুর দমন–পীড়ন।
প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ বাসিন্দা-অধ্যুষিত সিরিয়ায় সুন্নি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শাসনক্ষমতায় ছিল শিয়া অনুসারী আসাদ পরিবার। এ ক্ষেত্রে আসাদ ইরানের প্রত্যক্ষ সমর্থন পেয়ে আসছিলেন। ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় রাশিয়াও সিরিয়ার স্বৈরশাসকের পক্ষ নেয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তুরস্ক বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন জানায়। এ অবস্থায় দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। ১৩ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় ৬ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় কয়েক গুণ বেশি মানুষ।
২০২২ সালে বিদ্রোহীরা কিছুটা পিছু হটলেও সম্প্রতি লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর ইসরায়েলি আক্রমণের পর তারা নতুন করে বাশারবিরোধী যুদ্ধ শুরু করে। মাত্র ১২ দিনের ঝড়ে তাঁকে সপরিবার দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিতে হয়। উল্লেখ্য, বাশারের সরকারি বাহিনীর পক্ষে ইরান ও রাশিয়া ছাড়া লেবাননের হিজবুল্লাহও সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে আসছিল।
বাশারবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়া হায়াত তাহরির আল-শামসের নেতা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি, যিনি একসময় আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে তাদের থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দল গঠন করেন। আল-কায়েদার খেলাফত প্রতিষ্ঠার নীতি থেকেও সরে আসেন এই বিদ্রোহী নেতা।
এই প্রেক্ষাপটে সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তন গোটা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করি। বাশারের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও ইরান সরকার সিরিয়ার নতুন বাস্তবতা মেনে নিয়ে দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার অনুরোধ জানিয়েছে।
বাশার সাম্রাজ্যের পতনের পর সিরিয়ায় শান্তি ও গণতন্ত্র ফিরে আসবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। যদি ইসরায়েল দেশটিতে সশস্ত্র হামলা না চালায় এবং সিরিয়ার বিজয়ী বিদ্রোহী গ্রুপগুলো একসঙ্গে চলতে রাজি থাকে, তাহলে সেখানে স্থিতিশীলতা আনা অসম্ভব নয়। বিদ্রোহী নেতা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি নতুন সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত বাশার মনোনীত প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব পালনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
বাশার আল–আসাদের দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরশাসনে সিরিয়ার মানুষ অতিষ্ঠ ছিল, এ কথা সত্য। তবে সেখানকার রাজনৈতিক পরিবর্তনে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকাও অস্বীকার করা যাবে না। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিজয়ী বিদ্রোহীরা বিবদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের নীতি নেয়, তার ওপরও দেশটির ভবিষ্যৎ অনেকাংশ নির্ভর করছে।
এই মুহূর্তে সিরিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা জরুরি। দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরশাসনের পর দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠন তখনই সম্ভব হবে, যখন সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে এবং জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা যাবে।
এ ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়েরও বড় দায়িত্ব আছে বলে আমরা মনে করি।