সরকার কি আসলেই দুষ্টচক্র ভাঙতে চায়

সম্পাদকীয়

প্রথম আলোর যশোর প্রতিনিধির ‘৪০০ কোটি টাকা ব্যয়, তবু সড়ক টেকে না’ প্রতিবেদনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। প্রতিবেদক যে পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা হলো সাধারণ মানুষ—যারা সড়ক মেরামতের কারণে বছরের পর বছর ভোগান্তিতে আছে, সড়ক ও জনপথের প্রকৌশলী, ঠিকাদার, এই পথে চলাচলকারী গাড়িচালক ও গবেষক। প্রতিটি পক্ষ যা যা বলেছে, তা আমলে নিয়ে সত্যাসত্য বিচার করলেই সড়কের এই হাল হতো না।

দেশে সুশাসন ও জবাবদিহির ঘাটতি না থাকলে নিশ্চিতভাবেই ৯ বছরে সাতবার সড়ক মেরামতে জনসাধারণের পকেটের ৪০০ কোটি টাকা রাস্তায় ঢালা হতো না। যেমন প্রথমেই সরকার খতিয়ে দেখত কেন যশোর-নওয়াপাড়া সড়ক মেরামতের কয়েক মাস পরই ছালবাকল উঠে যাচ্ছে, খানাখন্দ, গর্ত থেকে মাটিই-বা কেন বেরিয়ে আসছে। বলা হচ্ছে, সড়ক মেরামত হলে ঠিকাদারের লাভ হয়।

খোঁজ নিয়ে সরকার দেখতে পারত, আসলেই তারা লাভ করছে কি না। প্রতিবেদনেই আছে, এই সড়ক মেরামতে বারবার ডাক পাচ্ছে দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যার একটির মালিক আওয়ামী লীগের বড় নেতা, অপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো বহুল আলোচিত তমা কনস্ট্রাকশন।

তমা কনস্ট্রাকশনের কর্মকর্তা বলেছেন, সড়ক মেরামতের ব্যয় শুধু ঠিকাদারেরা বাড়ান না। তার অর্থ কি প্রকৌশলীরাও ব্যয় বাড়াচ্ছেন? অস্বাভাবিক নয়। অল্প কিছুদিন আগে প্রথম আলোর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি কাজ শুরুর আগেই ঠিকাদারকে প্রকৌশলীর নিয়ম ভেঙে টাকা দেওয়ার খবর দিয়েছিলেন। প্রকৌশলী-ঠিকাদারেরা আবার একজোট হয়ে ট্রাকচালকদের দুষছেন। কারণ, তাঁরা এই সড়ক যতটুকু ভার বহন করতে পারে, তার চেয়ে বেশি বহন করছেন। কারণ, যশোর-খুলনা মহাসড়কের চেঙ্গুটিয়ায় ওজন নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র চালু নেই। ট্রাকচালক সমিতির আপত্তির মুখে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছাচারিতা আর কাকে বলে! আর এই অব্যবস্থাপনার চক্করে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন সাধারণ মানুষ।

প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ১৩৪টি সড়কবিষয়ক জরিপের উদ্ধৃতি আছে। এতে বেহাল সড়কের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে ১১৩ নম্বরে। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনও এক। ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট ২০১৯’-এ আছে, বাংলাদেশ ৯ বছরে ৪৬০ বিলিয়ন টাকা সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় করেছে। কিন্তু সড়কের মানের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা একমাত্র দেশের নাম নেপাল। নেপাল রাস্তা টেকাতে পারছে না। কারণ, অঞ্চলটি পাহাড়ি। বাংলাদেশের প্রায় পুরোটাই সমতল। তা-ও রাস্তাঘাটের মান খারাপ। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের স্কোর ১০০-তে ৩৫.২, যেখানে শ্রীলঙ্কায় ৪৬.৭, ভারতে ৫৭.৪ এবং পাকিস্তানে ৪৯.১।

এত বাজে পারফরম্যান্সের পরও সওজকে সরকার প্রতিবছর দুহাত ভরে দেয় কোনোরকম জবাবদিহি ছাড়াই। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ঈদের আগে সওজ রাস্তাঘাট যান চলাচলের উপযোগী করতে যথেচ্ছ খরচ করে। কেন প্রতিবছর রাস্তাঘাট মেরামত করতে হয়, কত টাকা কোন খাতে ব্যয় হয়, সেই তথ্য কখনো সরকার প্রকাশ করে না।

একটা ঢালাও হিসাব আছে, বছরে সড়ক মেরামত খাতে সরকারের ব্যয় ৫ হাজার কোটি টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে এই খাত বরাদ্দ পায় ২৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও তারা তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে। এই টাকা সওজ ফেলে-ছড়িয়ে নষ্ট করছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের চেয়ে আসলে শক্তিশালী কারা? ক্ষমতাসীন দলের নেতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান? কিছু অসৎ প্রকৌশলী, না ট্রাকচালক সমিতি? সরকার যদি সত্যিই সুশাসন চায়, তাহলে এই দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি আসলেই তা চায়?