পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত নয়

সম্পাদকীয়

আওয়ামী লীগ সরকার দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করেছিল, তার প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন—এ কথা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাপে যদি অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

অন্যদিকে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দাবিদাওয়ার পাহাড় নিয়ে তাদের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন, নতুন সরকারের জন্য তা অস্বস্তিকর। ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাদের কিছুটা সময় দিতে হবে।

গত মঙ্গলবার এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল নিয়ে সচিবালয়ে যা ঘটেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী সাড়ে ১৪ লাখের মতো। পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষা হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে বাকি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়।

অন্তর্বর্তী সরকার ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো কিছুটা শিথিলভাবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের একটা অংশ মঙ্গলবার সচিবালয়ে ঢুকে পরীক্ষা বাতিলের জন্য অবস্থান নিয়ে সময়সীমা বেঁধে দিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত তা মেনে নেয়। শিক্ষার্থীদের যুক্তি হলো, বারবার পরীক্ষা পেছানোয় তাঁরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এ ছাড়া কিছু শিক্ষার্থী আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

শিক্ষার্থীদের আবেগ ও যুক্তিকে বিবেচনায় নিয়েও এটা বলা যায় যে পরীক্ষা বাতিল সমস্যার সমাধান নয়। স্থগিত থাকা পরীক্ষার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি বিষয় আছে, আছে ব্যবহারিক পরীক্ষাও। এগুলো বাদ দিয়ে কেবল গড় ধরে ফল প্রকাশ করলে শিক্ষার্থীরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার ক্ষেত্রে এইচএসসি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইচএসসিতে ভালো ফল না করলে উচ্চশিক্ষা নেওয়া কঠিন হবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই গড় ফল গ্রহণ না-ও করতে পারে। এ ছাড়া বিদেশে যাঁরা উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী, তাঁরাও বিপদে পড়বেন।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অনেক নেতাও পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে নন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়, তবে চাপের কারণে এটি নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গতকাল বলেছেন, এইচএসসির স্থগিত পরীক্ষার ব্যাপারে আরও সময় নিয়ে বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন তঁারা।

স্থগিত পরীক্ষা বাতিল হওয়ার সিদ্ধান্তটি ভালো নজির হবে না বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরাও। যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, এতে শিক্ষার্থীদেরই ভুগতে হবে। নটর ডেম কলেজের সাধারণ এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের নামে দেওয়া একটি বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বলা হয়, এইচএসসির ফলাফল শুধু এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই মূল্যায়ন করা উচিত। তাঁদের অবস্থানটি পরীক্ষার পক্ষে। শুধু আহত (ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত) শিক্ষার্থীদের তালিকা করে তাঁদের বিষয় ম্যাপিং করার পক্ষে মত দেন তাঁরা।

পরীক্ষা বাতিলের পর অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী প্রথম আলোর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। তাঁদের যুক্তি হলো ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বাকি বিপুল শিক্ষার্থীর অবস্থান এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের একটি অংশের দাবি অনুযায়ী আহত শিক্ষার্থীদের তালিকা করে ম্যাপিং করার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। অথবা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির জন্য বাকি পরীক্ষাগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পিছিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। কারণ, আমরা মনে করি, কিছু বিষয়ে পরীক্ষা না দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তাঁদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা, বিশেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই বাকি পরীক্ষাগুলো শিথিল প্রশ্নপত্রে হলেও অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।