বৈদেশিক মুদ্রার মজুত যখন উদ্বেগজনক হারে কমে আসছে, বাজারে ডলার-সংকট তীব্র, তখন নির্বাচন সামনে রেখে ডিসি-ইউএনওদের জন্য নতুন গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
২১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি কিনতে ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রস্তাবে গত ২৭ আগস্ট অনুমোদন দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলার ডিসিরা পাবেন নতুন গাড়ি। আর ইউএনওদের জন্য কেনা হচ্ছে ২০০টি গাড়ি। শর্ত শিথিল করে তাঁদের ২৭০০ সিসির (ইঞ্জিনক্ষমতা) গাড়ি দেওয়া হচ্ছে, যা গ্রেড-১ ও ২ (সচিব ও অতিরিক্ত সচিব) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের প্রাধিকার।
যেখানে ডলার-সংকটের কারণে চিকিৎসা সরঞ্জামসহ অনেক অতি আবশ্যকীয় পণ্য আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে, সেখানে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে নতুন গাড়ি কেনার কী যুক্তি থাকতে পারে?
কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি দপ্তরে সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধ থাকবে বলে গত জুলাইয়ে পরিপত্র জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। পরিপত্রে বলা হয়েছিল, ১০ বছরের পুরোনো গাড়ি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিতে হবে। গাড়ি কেনা বন্ধের কথা জানিয়ে ২০২০ সালের জুলাইয়ে এবং ২০২২ সালের জুলাইয়ে দুটি পরিপত্র জারি করেছিল অর্থ বিভাগ। এখন তারাই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এল।
যেখানে বাজেটে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গাড়ি কেনাকাটায় ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ৩৮০ কোটি টাকা খরচ করার অনুমোদন দিল অর্থ বিভাগ। তাহলে বাজেট প্রণয়নের দরকারটা কী। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন সামনে রেখে সরকার এসব দামি গাড়ি ডিসি-ইউএনওদের উপঢৌকন হিসেবে দিতে দিল বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। গত মাসে প্রস্তাবটি অর্থ বিভাগে পাঠানোর সময়ই আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম।
বাস্তবতা হলো, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যেটি চান না, তা যতই অত্যাবশ্যকীয় হোক, সময়মতো কার্যকর হয় না। আর তাঁরা যেটি চান, আবশ্যকীয় না হওয়া সত্ত্বেও তা বাস্তবায়িত হয়ে যায়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যসংখ্যা এবং ভারত ও পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সংখ্যা মিলিয়ে দেখলেও বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
সরকারের দাবি, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে। অথচ এক বেলা বৃষ্টি হলে দেড় কোটি মানুষের ঢাকা শহরের জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। পানিনিষ্কাশনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। একদিকে টাকার সংকটের কারণে সরকার কয়েকটি খাতে ভর্তুকির অর্থ যথাসময়ে দিতে পারছে না, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে দেওয়া হয়েছে, সার, বিদ্যুৎ ও পানির দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি কেবল স্ববিরোধী নয়, আত্মঘাতীও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান যথার্থই বলেছেন, ‘এখন ডলার-সংকট চলছে। এই সময়ে গাড়ি কেনা অগ্রাধিকারে থাকা উচিত নয়।’ যে কাজটি করা উচিত নয়, সেটাই সরকার করে থাকে। আর যেটি করা উচিত, সেটা করে না। সরকার যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে ডিসি-ইউএনওদের জন্য যে গাড়ি কিনছে, সেই অর্থ তো আকাশ থেকে আসবে না, মাটি থেকেও গজাবে না। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থেই এর জোগান দিতে হবে।