মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিবেচনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইনের একটি। ডিজিটাল বা সাইবার পরিসরে নাগরিক অধিকার সুরক্ষার বদলে ক্ষমতাসীনদের রক্ষার এবং বিরোধীদের দমনের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের তীব্র সমালোচনার মুখে কয়েকটি ধারা সামান্য কিছু সংশোধন করে ২০২৩ সালে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি ছিল নতুন মোড়কে পুরোনো নিবর্তনমূলক আইন।
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নাগরিকদের অন্যতম দাবি ছিল বিতর্কিত সাইবার সুরক্ষা আইনটি বাতিল করা। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করে। ২৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৪-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে এমন ধারা ও বিষয় থেকে গেছে, যেগুলো নাগরিকের স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া নতুন করে যুক্ত করা সাইবার বুলিং-সংক্রান্ত ধারাটি সমালোচনার জায়গা সংকুচিত করবে বলে মনে করছেন অংশীজনেরা। অধ্যাদেশটি অনুমোদনের আগে অংশীজনদের মতামত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি। সামগ্রিক বিবেচনায় সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের যে খসড়া, তাতে অপব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ থেকেই গেল।
সরকারের তরফ থেকে যদিও বলা হয়েছে, এ অধ্যাদেশ দ্বারা সাইবার পরিসর ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। কিন্তু অংশীজন, অধিকারকর্মী ও সাইবার আইনবিশেষজ্ঞরা অধ্যাদেশটি নিয়ে যেসব প্রশ্ন, সংশয় ও সমালোচনা তুলে ধরেছেন, সেগুলো যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
অনুমোদিত খসড়া পর্যালোচনায় দেখা যায়, এতে বিতর্কিত আটটি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব ধারায় নিষ্পন্নাধীন কোনো মামলা বা অন্যান্য কার্যধারা ও তদন্ত বাতিল হবে। এসব ধারায় আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ড ও জরিমানা বাতিল হবে। এটিকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এসব ধারার মামলায় বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। নতুন অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসে জুয়াখেলার অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অধ্যাদেশে নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকার রাখা হয়েছে, এটিও একটি ইতিবাচক অগ্রগতি।
নতুন সাইবার অধ্যাদেশে পুরোনো আইনের মতোই পরোয়ানা, তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের বিধান রাখা হয়েছে, যেটি উদ্বেগজনক। অধ্যাদেশে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেলিং ও অশ্লীল বিষয়বস্তুর প্রকাশসংক্রান্ত একটি ধারা। এ ধারার মূল বিষয়বস্তু মানহানি ও অপমানসংক্রান্ত, এ অপরাধের জন্য অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড ও উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মতপ্রকাশকেই অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এ দুটি আইনে এমন সব ধারা ও বিধান ছিল, যেগুলো নাগরিকের অধিকার হরণ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করার কাজে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ায়ও এমন ধারা রাখা হয়েছে, যেটির মাধ্যমে আইনটি অপব্যবহারের অস্ত্র ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর ২০২৪) সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে এক পর্যালোচনায় জানিয়েছে, এটি আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের একধরনের পুনরাবৃত্তি। অধ্যাদেশটিতে অনেক শব্দের ব্যাখ্যা নেই, ভাষা দুর্বোধ্য ও বিভ্রান্তিকর। এতে অপব্যবহারের সুযোগ রয়ে গেছে।
আমরা মনে করি, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ চূড়ান্তভাবে পাসের আগে পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কেননা, আইনটির যেমন বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে, আবার এর অংশীজনও বহু। ফলে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে আইনটি চূড়ান্ত করা না হলে এর উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে পারে।