দুই বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলে দিলেও তার সুফল ভাগ্যান্বেষী বাংলাদেশি নাগরিকেরা পাননি, পেয়েছে জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার একটি চক্র। গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, সাম্প্রতিক কালে এই চক্রের খপ্পরে পড়ে যাঁরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়ায় গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ চাকরি না পেয়ে সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আইন অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় যেতে একজন শ্রমিকের ৮০ হাজার টাকা লাগার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকদের দিতে হয়েছে চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, নতুন করে আর বিদেশি কর্মী নিয়োগের কোনো আবেদন অনুমোদন করছে না মালয়েশিয়া সরকার। যাঁরা ইতিমধ্যে অনুমোদন নিয়েছেন, তাঁদের ৩১ মার্চের মধ্যে ভিসার জন্য আবেদন জমা দিতে হবে। এরপর আর কর্মীদের ভিসার আবেদন নেবে না দেশটি। যাঁরা ইতিমধ্যে ভিসা নিয়েছেন বা নেবেন; তাঁদের মালয়েশিয়ায় প্রবেশের শেষ সময় আগামী ৩১ মে। এরপর থেকে সেখানে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক চাকরি নিয়ে যেতে পারবেন না।
সরকার প্রথমে ২৫টি এজেন্সিকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির অনুমতি দিয়েছিল। পরে এই সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০ করা হয়। এসব এজেন্সির মালয়েশীয় কিছু বেসরকারি এজেন্সির সঙ্গে মিলে জনশক্তি পাঠানোয় নানা জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৯২ সাল থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গেছেন সাড়ে ১২ লাখ বাংলাদেশি কর্মী। এর মধ্যে গত বছর গেছেন সাড়ে তিন লাখের বেশি। এর আগের বছর গেছেন ৫০ হাজার কর্মী।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় পাঠাতে প্রত্যেক কর্মীর জন্য দেড় লাখ টাকা দিতে হয় ১০০ এজেন্সির নামে গড়ে ওঠা চক্রকে। এরপর একই চক্রের অধীন থাকা স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে বাণিজ্য চলছে। এতে একজন কর্মী চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় গেছেন। তবে গিয়ে চাকরি পাননি অনেকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা থেকে মালয়েশিয়া সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকায় দেশটি নতুন করে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র গড়ে দুর্নীতি করেছে, এমন অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর দুই দেশের মধ্যে অনেক আলোচনার পর ২০২২ সালের আগস্টে আবার শ্রমবাজার খুলে দেওয়া হয়। জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি সব এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত রাখার আন্দোলন হলেও তা করা হয়নি শেষ পর্যন্ত।
সরকারের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলছেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। কর্মী পাঠানোয় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। তাঁর এই আশাবাদের ভিত্তি কী? পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর মালয়েশীয় রাষ্ট্রদূত হাজনাহ মো. হাশিম ‘দুই প্রান্তের চক্রের’ কথা স্বীকার করেছেন।
মালয়েশীয় চক্রের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যবস্থা নিতে পারবে না ঠিক। কিন্তু এ প্রান্তে যেসব চক্র আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধা কোথায়? ২০১৮ সালের আগে যাদের জালিয়াতির কারণে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া রহস্যজনক। তাহলে কি সরকার চায় মালয়েশিয়াগামী নাগরিকেরা সে দেশে গিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করুক?