কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। এ কয়দিনের প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার সম্পাদকীয়, লেখা ও সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। সোমবার (২২ জুলাই ২০২৪) এ সম্পাদকীয় ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গতকাল যে রায় দিয়েছেন, তাতে কোটাসংক্রান্ত জটিলতার অনেকটাই অবসান হয়েছে। আপিল বিভাগ কোটা নিয়ে সরকারের ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালে পরিপত্রের মাধ্যমে কোটাব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিল। গতকালের রায়ে আপিল বিভাগ ৯৩ শতাংশ সরকারি চাকরি মেধার ভিত্তিতে এবং বাকি ৭ শতাংশ কোটাভিত্তিক করার নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে আদালত এটাও বলেছেন যে এই কোটা কমানো-বাড়ানো বা বাতিল করার এখতিয়ার সরকারের।
আপিল বিভাগের রায়ে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ আসন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে। আদালতের এই নির্দেশনার ভিত্তিতে সরকারকে ‘অনতিবিলম্বে’ গেজেট বা প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলা হয়েছে।
আপিল বিভাগের গতকালের রায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এই রায়ের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে কোটা–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া পুরোপুরি সরকারে নীতিনির্ধারণী বিষয়। আদালত কিছু বিবেচনায় ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করলেও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘অত্র নির্দেশনা ও আদেশ প্রদান সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজন ও সার্বিক বিবেচনায় এই আদালত কর্তৃক নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।’
আপিল বিভাগের রায়ের ফলে একসময়ের ৫৬ শতাংশ কোটা বর্তমানে ৭ শতাংশে এসে দাঁড়াল। মাঝে ২০১৮ সাল থেকে অবশ্য কোনো কোটাই কার্যকর ছিল না। তা ছাড়া আগে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্য যে কোটা ছিল, তা–ও এখন থাকছে না। বর্তমানে তা কার্যকর হবে শুধু তাঁদের সন্তানদের জন্য। তবে আপিল বিভাগের এই রায় সব গ্রেডের সরকারি চাকরির জন্য প্রযোজ্য হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
উচ্চ আদালতের এই রায়ের পর কোটাসংক্রান্ত সবকিছুই এখন নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। কারণ, আদালত যে কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা সরকার নিজের মতো পরিবর্তন বা বাতিল করতে পারবে। এখানে উল্লেখ্য যে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাও সরকারের কাছ থেকেই কোটার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুতি ও সিদ্ধান্ত চেয়ে আসছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন একটি জায়গায় আসার আগে অসংখ্য প্রাণ ঝরে গেছে এবং দেশ পড়েছে এক নজিরবিহীন সহিংসতার কবলে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আদালতের এই রায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কতটা ভূমিকা রাখবে? এই বাস্তবতা মানতে হবে যে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা আর সেখানে নেই। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটিকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রাথমিক দায়টি যে সরকার ও সরকারি দলের, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ কম। এখন পরিস্থিতি এক ভিন্ন রূপ নিয়েছে। দেশজুড়ে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চলছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা হচ্ছে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে, কারফিউ জারি করে ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছে।
আদালতের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, অভিভাবকদের প্রতি সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরত পাঠানো এবং সরকারের প্রতি শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়েছে।
আমরা মনে করি, আদালত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সরকারের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন, সেখানে সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক দিনে যা ঘটে গেছে, সেই ক্ষত দূর করার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। কোটা সংস্কার চাইতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের যে জীবন দিতে হলো, তাঁদের সেই ক্ষোভ কীভাবে প্রশমন করা হবে, সেই পথ সরকারকে বের করতে হবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এখন যে দাবিগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।