বিদ্যমান আইনেই সুরক্ষা সম্ভব

সম্পাদকীয়

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী রাজনীতিকেরা বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে কানাডাভিত্তিক প্রযুক্তি অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের গবেষণায় উঠে এসেছে। ১১ জুন প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে আক্রমণ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অপতথ্যের লিঙ্গভিত্তিক চিত্র’।

গবেষণায় ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ফেসবুক পেজ ও গ্রুপের পাবলিক পোস্ট ও এসবের প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করা হয়। যেসব কনটেন্ট ভুল বা বানোয়াট, সেগুলো ভুল বা ভুয়া তথ্য এবং যেগুলো বিকৃত করা হয়েছে, সেসব অপতথ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।

জাতীয় নির্বাচন ঘিরে নারীদের নিয়ে কীভাবে অপতথ্য তৈরি করা ও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা ফেসবুকের ২৫ হাজার কনটেন্ট (আধেয়) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে। এতে অন্তরঙ্গ ছবির অপব্যবহার, ডক্সিং (কারও পোস্ট করা ব্যক্তিগত তথ্য ভুয়া আইডি তৈরিসহ হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা), ট্রলিং, সম্মতি ছাড়া ডিপফেক ছবি তৈরি ও যৌন হয়রানির মাধ্যমে আক্রমণ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায, পুরুষ রাজনীতিকের চেয়ে নারী রাজনীতিকেরা বেশি আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্য এবং বিরোধী দলের শীর্ষ নেত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাও এ থেকে রেহাই পাননি।

এর আগে ২০২২ সালে একশনএইডের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অনলাইনে প্রতি ১০০ নারীর মধ্যে ৬৪ জন কোনো না কোনোভাবে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। রাজনীতিকদের নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা আর তাঁদের সম্পর্কে অপপ্রচার ও বিদ্বেষ ছড়ানো এক কথা নয়। সরাসরি বা সাইবার—যেই মাধ্যমেই আসুক না কেন,অপপ্রচার ও বিদ্বেষ ছড়ানো বরদাশত করা যায় না।

টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের চিফ অব স্টাফ ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফৌজিয়া আফরোজ বলেছেন, রক্ষণশীল সংস্কৃতি ও সামাজিক আচরণ নারীকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। তবে এই অপপ্রচারকে শুধু রক্ষণশীল আচরণ বলে চিহ্নিত করলে সবটা বলা হয় না। এটা অসুস্থ মানসিকতারও বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, নারী শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়ছে না। এর পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধারাবাহিক আক্রমণও কম দায়ী নয়। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নারীর প্রতি আক্রমণের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ছিল। ওই সময়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়ই রাজপথে সক্রিয় ছিল। মাঠে সক্রিয়তার পাশাপাশি তাঁদের সমর্থকদের একাংশ যে অপতথ্য ও অপপ্রচারে লিপ্ত ছিলেন, গবেষণায় সেটাই উঠে এসেছে।

সরকারের নীতিনির্ধাকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত অপতথ্য নিয়ে প্রায়ই কথা বলেন। কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও অপতথ্য প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না। এটা খুবই দুঃখজনক। সাইবার মাধ্যমে অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছিল। বাস্তবে দেখা গেল, এটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নির্বিচার ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীকালে সাইবার নিরাপত্তা আইনও একই ধারায় চলছে বলে অভিযোগ আছে।

আমরা মনে করি, ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ বিশেষ করে নারীর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় নতুন নতুন আইনের প্রয়োজন নেই। বিদ্যমান যেসব আইনে নারীর সুরক্ষার কথা বলা আছে, সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই এ ধরনের অপরাধ কমে যাবে।