আমরা আর কোনো প্রাণহানি চাই না

কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। ফলে রোববার (২১ জুলাই ২০২৪) প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত এ সম্পাদকীয় এখন অনলাইনে প্রকাশ করা হলো।

কয়েক দিন ধরে দেশে যা ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে, তা নজিরবিহীন। সরকারের বেসামরিক প্রশাসন এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। দেখা গেছে, ধারাবাহিকভাবে সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে, মৃতের সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে পরের দিন ছাপিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার রাতে সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি করে।

এটা পরিষ্কার যে বেসামরিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। শুক্রবার রাত থেকে জারি হওয়া অনির্দিষ্টকালের কারফিউ (দুপুর ১২টা থেকে ২ ঘণ্টার বিরতিসহ) অব্যাহত রয়েছে।

এ সময়েও রাজধানী ঢাকার রামপুরা-বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও মিরপুর এবং সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। গতকাল দেশে আরও ২৬টি প্রাণ ঝরেছে। সব মিলিয়ে চার দিনে মারা গেছেন ১৪৮ জন।

কোটা সংস্কারের দাবির মতো একটি অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন এই পরিণতি পাবে, তা ছিল অকল্পনীয়। বলা যায়, এই আন্দোলন সরকার যেভাবে সামাল দিতে চেয়েছে, তা তো কাজে দেয়ইনি; বরং বিরূপ ফল দিয়েছে। দেশের সচেতন মহল শুরু থেকেই কোটা সংস্কার প্রশ্নে সরকারকে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সময়ক্ষেপণ না করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার তা বিবেচনায় নেয়নি এবং নিজেদের অবস্থানে শেষ পর্যন্ত অনমনীয় থাকার পথ নিয়েছে। যখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

আন্দোলন নিয়ে এত রক্তপাত, এত প্রাণহানি, এত সহিংসতা কখনো বাংলাদেশ দেখেনি। সবকিছু মিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনটি এখন আর সেখানে আটকে নেই। এর বিস্তৃতি ঘটেছে এবং ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং সরকারি অফিস ও স্থাপনায় হামলাসহ কয়েক দিন ধরে দেশে যা ঘটছে, তা অগ্রহণযোগ্য।

আন্দোলনকারীরা সরকারের তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে আট দফা দাবি পেশ করেছেন। এসব দাবির ব্যাপারে সরকারের প্রতিক্রিয়া বা পদক্ষেপ কী হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। পাশাপাশি সেনাবাহিনী নামিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, কত দ্রুত তার ফল পাওয়া যাবে বা তার ফল কী দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তা ছাড়া আজ উচ্চ আদালতে কোটা–সংক্রান্ত শুনানির তারিখ নির্ধারিত রয়েছে, এর ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে।

লাগাতারভাবে যে সংঘাত ও সহিংসতা চলছে, তা দেশের জনজীবনকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান দরকার। দেশজুড়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। দেশের ভেতরে ও বাইরের আর্থিক লেনদেন ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখন পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর।

দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো ইন্টারনেটের অভাবে তাদের অনলাইন কার্যক্রম চালাতে পারছে না এবং সামগ্রিকভাবে তাদের কর্মকাণ্ড খুবই সমস্যার মধ্যে পড়েছে। সরকার একদিকে ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশের স্লোগান দিচ্ছে, অন্যদিকে ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছে—বিষয়টি পরস্পরবিরোধী। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ হিসেবে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সরকারের উচিত ইন্টারনেট সেবা খুলে দেওয়া।

আমরা আশা করব, আইনশৃঙ্খলার দিক ছাড়াও পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনৈতিকভাবে যা করা দরকার, তা সরকার করবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করা ও তাঁদের ক্ষোভ দূর করার সব উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ করছে। এই সহিংস পরিস্থিতির এখনই অবসান হোক। আমরা আর প্রাণহানি চাই না।