অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করুন

সম্পাদকীয়

অতীতে সামাজিক আন্দোলন ও গণসচেতনতার মাধ্যমে অ্যাসিড-সন্ত্রাস কমানো সম্ভব হলেও সাম্প্রতিককালে নতুন করে অ্যাসিড নিক্ষেপের কিছু ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়ে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার অন্তঃসত্ত্বা মিলি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তিনি অ্যাসিডের যন্ত্রণার পাশাপাশি গর্ভের সন্তান নিয়েও চিন্তিত।

১০ মাস আগে সৌদিপ্রবাসী এক তরুণের সঙ্গে মিলির বিয়ে হয় এবং বর্তমানে তিনি অাট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ১০ দিন আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বেড়াতে এলে শফিকুল ইসলাম নামের এক বিবাহিত যুবক তাঁর শরীরে অ্যাসিড ঢেলে দেন। শফিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনায় সৌদিপ্রবাসী অপর এক যুবকের ইন্ধন আছে বলেও অভিযোগ করেছেন মিলির বাবা।

মিলি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, কিন্তু গত বছর সেপ্টেম্বরে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় অ্যাসিডে দগ্ধ সাদিয়া আক্তারকে বাঁচানো যায়নি। অন্যত্র বিয়ের খবর জেনে সাবেক স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর শরীরে অ্যাসিড ছুড়ে মারেন। গত ডিসেম্বরে পুরান ঢাকায় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রকাশ্যে এক নারীকে অ্যাসিড ছুড়ে মারে তিন দুর্বৃত্ত। এ নিয়ে মামলা হলেও পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

গত আগস্টে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘অ্যাসিডবিরোধী সংলাপ: অ্যাসিড-সন্ত্রাস নির্মূলে করণীয়’ শীর্ষক সংলাপেও অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন বক্তারা। ২০০২ সালে অ্যাসিডদগ্ধের সংখ্যা ছিল ৪৯৬, যা পরে সামাজিক সংগঠন ও গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং সরকারের আইন প্রণয়নের ফলে অনেকটাই কমে যায়। ২০১৮ সালে অ্যাসিডদগ্ধের সংখ্যা ছিল ২২। ২০২২ সালে তা বেড়ে ২৯ হয়েছে।

অ্যাসিড-সন্ত্রাসের প্রধান শিকার নারী। শিশুরাও এ সন্ত্রাসের বড় ভুক্তভোগী। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২৪ বছরে অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিদের ৬০ শতাংশ নারী, বাকিরা শিশু ও পুরুষ। বর্তমানে প্রায় ৬০০ মামলা অ্যাসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে ১৪ জনের; যদিও কারও ফাঁসি কার্যকর হয়নি।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২-এর অধীন ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে ২৩৮টি মামলা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্য অনুসারে, ১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে দেশে ৩ হাজার ৮৭০ জন অ্যাসিডে দগ্ধ হয়েছেন। ২০২৩ সালে আট নারী, তিন পুরুষ ও দুই শিশু দগ্ধ হয়।

অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২-এর ৫ ধারার দুটি উপধারায় অ্যাসিডে ক্ষতির পরিমাণ অনুপাতে অপরাধীর শাস্তি নির্ধারণ করা আছে। এতে সর্বনিম্ন ৭ বছর ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। ৬ ধারা অনুসারে অ্যাসিড নিক্ষেপ বা নিক্ষেপের চেষ্টা করলে সর্বনিম্ন ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড হবে। আর ৭ ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করলে তিনি নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

অ্যাসিড-সন্ত্রাস একদিকে যেমন জঘন্যতম অপরাধ, তেমনি এটা একটা বড় সামাজিক সমস্যাও। পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে নারীরা মূলত অ্যাসিড–সন্ত্রাসের শিকার হন। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের এই ব্যাধি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে প্রতিটি ঘটনায় অপরাধীর শাস্তির পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন ও গণসচেতনতা জারি রাখতে হবে। এই কাজটি করতে হবে পরিবার থেকেই।