এত মৃত্যুর দায় কার

সম্পাদকীয়

সরকার এমন এক সময়ে কোটা আন্দোলনকারীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে, যখন গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১০টা পর্যন্ত অন্তত ২৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। পুরো দেশ হয়ে পড়েছে সহিংসতাকবলিত। এ ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি কি এড়ানো যেত না? শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি কেন এই পরিণতির দিকে গেল? জনমনে সাধারণ ধারণা হচ্ছে সরকারের অদূরদর্শী অবস্থানই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।  

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যখন বারবার আলোচনার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন, সরকারের তরফে ইতিবাচক ঘোষণার আশ্বাসের অপেক্ষায় ছিলেন, তখন আদালতের দোহাই দিয়ে সরকার বিষয়টি এড়িয়ে চলার নীতি নেয়।

ফলে শিক্ষার্থীদের মনে কোটা সংস্কার বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং তাঁরা নির্বাহী বিভাগের উদ্যোগের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি তখনই সহিংসতায় রূপ নেয়, যখন সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা শুরু করে।

ঘটনার পরম্পরা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত’ ঘোষণার পরই সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ চড়াও হয়, সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বুধবার বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসছাড়া করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে।

এই প্রেক্ষাপটে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বৃহস্পতিবার সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করেন এবং সারা দেশে শিক্ষার্থী-তরুণেরা রাজপথে নেমে আসেন। তঁাদের সমর্থনে সাধারণ জনগণকেও মাঠে দেখা গেছে। এই বিক্ষোভে পুরো বাংলাদেশ কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।

সরকার শক্তিপ্রয়োগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে গেলে শিক্ষার্থীরা ও সাধারণ জনগণ এর পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে এবং মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে শিক্ষার্থীসহ অন্ত ৩৩ জন মারা যান। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ভয়াবহ ঘটনা বিরল।

এই প্রেক্ষাপটে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীদের প্রতি সংলাপের যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা নিশ্চিতভাবেই সরকারের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া। এক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, তখনো সংলাপের প্রস্তাব আসেনি।

আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে আইনি প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া দ্রুত মেনে নেওয়ারও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলিতে যে এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল, এত মানুষ আহত হলেন, দেশজুড়ে সহিংসতায় যে এত সম্পদ ধ্বংস হলো, তার দায় কে নেবে?

আমরা মনে করি, যেকোনো সমস্যাই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব এবং এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই আমরা তা বলে আসছি। সরকার তা বিবেচনায় নিলে দেশ আজ এই ভয়াবহ বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ত না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সংলাপের যে আহ্বান সরকারের তরফে দেওয়া হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি পায়, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে যেকোনো আলোচনার পরিবেশ তৈরির জন্য একটি আস্থার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হয়।

দেশজুড়ে যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহনশীলতা ও ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সরকারকে কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে এবং নিজেদের কর্মী নামিয়ে আন্দোলন দমনের কৌশল পরিহার করতে হবে।

সরকারকে মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবির প্রতি দেশের মানুষের সমর্থন রয়েছে। বলপ্রয়োগ করে এই ন্যায্য আন্দোলন দমনের চেষ্টা হবে আত্মঘাতী।