স্বাস্থ্যসেবাবিশেষজ্ঞরা আগেই জানিয়েছিলেন, বন্যাদুর্গত অঞ্চলে পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গত এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানির অভাবে এসব এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাস্তবেও সেটি ঘটেছে।
আমাদের স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা হলো রোগীকে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর কাছে যান না। স্বাভাবিক অবস্থায় এটি হয়তো মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব হয় না। অনেক এলাকায় পানি কমলেও সড়ক যোগাযোগ চালু করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই হলো তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর প্রধান অবলম্বন।
কিন্তু সমস্যা হলো এসব প্রতিষ্ঠানে যে লোকবল, অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও ওষুধ থাকা দরকার, তা থাকে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছিল, তার অবস্থাও ‘সাধ আছে, সাধ্য নেই’ ধরনের। সব গ্রামে ক্লিনিকও নেই। যেসব গ্রামে আছে, আশপাশের গ্রামের মানুষ সেখানে আসেন স্বাস্থ্যসেবা নিতে।
এবার কয়েক দিনের ভয়াবহ বন্যায় পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলার যোগাযোগব্যবস্থা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। পাশের গ্রাম তো দূরের কথা, পাশের বাড়িতে যাওয়ারও উপায় নেই। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে জানা যায়, দুর্গত এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে যেতেই ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ জ্বর, সর্দি–কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অনেকের হাতে–পায়ে ঘা, খোস–পাঁচড়া দেখা দিচ্ছে।
৯ দিন ধরে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করায় ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লায় বয়স্ক ও শিশুরা জ্বর, সর্দি–কাশি ও ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। দুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, পানির কারণে বন্ধ আছে অনেক কমিউনিটি ক্লিনিক। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে ১১ জেলায় ৬১৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
তাহলে এতগুলো মেডিকেল টিম কোথায় কাজ করছে? তাঁদের কার্যক্রম কি সড়ক–মহাসড়কের পাশেই সীমিত?
ফেনীর সিভিল সার্জন মো. শিহাব উদ্দিনও স্বীকার করেছেন, দুর্গত এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ খুব বেশি। উপজেলা, জেলাসহ সব হাসপাতালে রোগী বেড়েছে। ডায়রিয়ার স্যালাইন এবং ওআরএসের সংকট আপাতত তেমন নেই। লক্ষ্মীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ইউনিয়ন পর্যায়ের ৪০টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও তিনটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র পানিতে ডুবে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে বন্যার্তদের ভালো চিকিৎসা দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে।
সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কতজন রোগী এসেছে, তার হিসাব দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা কতজন রোগীর কাছে গেছেন, সেটা বলছেন না। যখন দুর্গত মানুষের পক্ষে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না, তখন স্বাস্থ্যকর্মীদেরই তাঁদের কাছে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে নৌযানের সমস্যা থাকলে সেটাও সমাধান করতে হবে। পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে বন্ধ হয়ে যাওয়া কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো খুলে দেওয়া যায়, দ্রুত সেই ব্যবস্থাও করতে হবে।
দুর্গত এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে আরও বেশি মেডিকেল টিম পাঠাতে হোক। কেবল টিম পাঠালেই হবে না, তঁাদের কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীও থাকতে হবে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, সেখানে এক দিনও বিলম্ব করা যাবে না।