প্রতিবছর বাজেট এলে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে কালোটাকা সাদা করার বিষয়টিও সামনে আসে। স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকারই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। বিরোধী দলে থাকতে যঁারা কালোটাকা সাদা করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তাঁরাই ক্ষমতায় গিয়ে কালোটাকা সাদা করার নানা কৌশল খুঁজতে থাকেন। এই ধরনের রাজনৈতিক দ্বিচারিতা অর্থনীতি কিংবা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনে না।
এনবিআরের সূত্রগুলো বলছে, এ পর্যন্ত অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে, অর্থাৎ সাদা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের ১৫ বছরে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা সাদা হয়। আওয়ামী লীগের শেষ তিন মেয়াদে (২০০৯-২৩) প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বৈধ হয়েছে।
এবার বাজেট ঘোষণার আগেই ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বরাতে প্রথম আলো জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে এবং সেটা হতে পারে এক বছরের জন্য।
আগামী ৬ জুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এটি হবে তাঁর প্রথম ও আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেট। বাজেটের সম্ভাব্য কাঠামো সম্পর্কে যেসব তথ্য সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। অতীতের মতো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত এবারও উপেক্ষিতই থাকছে।
দুই বছর আগে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এতে তেমন সাড়া না পাওয়ায় পরে এ সুযোগ বাতিল করা হয়। পরের বছর দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলেও কেউ সেই সুযোগ নেননি। যাঁরা সরকারকে ফাঁকি দিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, তাঁরা সরকারের ‘সাধু’ প্রস্তাবে সাড়া দেবেন, এটা কী করে ভাবলেন নীতিনির্ধারকেরা? সে সময় সরকারের এই পদক্ষেপ নিয়ে কঠোর সমালোচনা হলেও নীতিনির্ধারকেরা আমলে নেননি। বাস্তবতা হলো বিদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসার বদলে গত কয়েক বছরে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
কালোটাকা সাদা করা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে অতীতে বিতর্ক ছিল, এখনো আছে। এর পক্ষের যুক্তি হলো বৈধভাবে অর্জিত আয় অনেকেই এনবিআরে প্রদর্শন করেন না। এটি বৈধতা না দিলে আরও বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। অন্যদিকে বিরোধীদের যুক্তি হলো, সৎ করদাতারা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দিয়ে থাকেন। কিন্তু যাঁরা অর্জিত আয় প্রদর্শন করলেন না, তাঁরা ১০ কিংবা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিলেন। এটা অনৈতিক ও বেআইনি। এতে সৎ করদাতারা যেমন নিরুৎসাহিত হবেন, তেমনি অসাধুরা আশকারা পাবেন।
প্রচুর পরিমাণে কর ফাঁকি কিংবা বিদেশে অর্থ পাচার—দুটোই সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার গুরুতর দুর্বলতা বলে মনে করি। এ থেকে উত্তরণের উপায় হলো আর্থিক খাতের অনিয়ম, অব্যবস্থা ও দুর্নীতি কঠোর হাতে বন্ধ করা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে কালোটাকা সাদা করার প্রয়োজন হবে না। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতেও সরকারকে সম্পূর্ণ নিষ্ফল ও অকার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে না।