গত ২২ জুলাই ঝালকাঠিতে একটি যাত্রীবাহী বাস পুকুরে পড়ে ১৭ জন নিহত হন। সেটি পুরোনো খবর হলেও তার রেশ রয়ে গেছে।
দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি যেসব কারণ চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে আছে চালকের খামখেয়ালিপনা, অপেশাদারি আচরণ, হালকা গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে ভারী যানবাহন চালানো, প্রভৃতি।
তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঝালকাঠি থেকে পিরোজপুর বা মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা সড়কটি অত্যন্ত পুরোনো। মহাসড়কের পাশে যে সুরক্ষা থাকা দরকার, সেটাও সেখানে ছিল না।
সড়কের পাশে যে পুকুরে বাসটি পড়ে যায়, সেটিকে মৃত্যুকূপ বলে অভিহিত করেছে তদন্ত কমিটি। বাংলাদেশের সড়কের আনাচে–কানাচে এ রকম অসংখ্য মৃত্যুকূপ আছে।
গত শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ৩৫ টন ওজনের একটি কনটেইনারসহ লরি চলন্ত প্রাইভেট কারের ওপর পড়ার ঘটনাটিকেই বা আমরা কীভাবে দেখব? এটাকেও নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। গত মে মাসে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা স্টিল মিল বাজার এলাকায় লরি থেকে দড়ি ছিঁড়ে ছিটকে গিয়ে পণ্যবাহী একটি কনটেইনার রিকশার ওপর পড়লে দুজন আরোহী মারা যান। সড়কে নামলেই এখন মানুষকে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।
গত শুক্রবার গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার কোটবাজালিয়া গ্রামে কাপাসিয়া-ভাকুয়াদি সড়কে ট্রাকচাপায় সাংবাদিক মঞ্জুর হোসেন মিলনের মৃত্যুর ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী ওই সাংবাদিক সড়কের পাশে ছিটকে পড়েন।
এরপর তিনি ট্রাক থামিয়ে ধাক্কা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক হয়। এরই মধ্যে চালক ওই সাংবাদিকের ওপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে যান। পরিবারের পক্ষ থেকে একে পরিকল্পিত হত্যা বলে অভিযোগ করেছেন। ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
যাত্রীবাহী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে সারা দেশে ৫০৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৭৬ জন নিহত হন। আহত হন ১ হাজার ৫৫ জন। জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ঢাকা বিভাগে। ১৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭৩ জন নিহত ও ২৭১ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম ছিল বরিশাল বিভাগে—২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮ জন নিহত ও ১৩৮ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় হতাহতের এই হিসাব চূড়ান্ত নয়। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর থেকেই যাত্রী কল্যাণ সমিতি হতাহতের পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে। সব দুর্ঘটনার খবর পত্রিকায় আসে না, থানায়ও ডায়েরি করা হয় না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। যদিও সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা দুই থেকে আড়াই হাজার।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে অনেক আন্দোলন হয়েছে, আইন হয়েছে, কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি। নিরাপদ করার কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেই সরকারের পক্ষ থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।
কেন সরকার সেই পথে হাঁটছে না? ছাত্র-কিশোরদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে সরকার সড়ক পরিবহন আইন করলেও সেটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি মালিক ও শ্রমিকদের আপত্তির কারণে।
অথচ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসেই ৪৫ জন চালক মারা গেছেন দুর্ঘটনায়। সড়ক নিরাপদ থাকলে চালক, যাত্রী, মালিক—সবাই নিরাপদ থাকবেন। নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলতে আইন করাই যথেষ্ট নয়, এর যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে।