আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাল্যবিবাহে বাংলাদেশের দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে থাকা খুবই লজ্জার কথা।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-এর দ্বিতীয় ধারার তৃতীয় অনুচ্ছেদে বিয়ের জন্য আইনে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স যথাক্রমে ১৮ ও ২১ বছর উল্লেখ রয়েছে। এর কম বয়সে কারও বিয়ে হলে সেটি অপ্রাপ্তবয়স্ক বা বাল্যবিবাহ হিসেবে চিহ্নিত হবে। বাল্যবিবাহ কেবল সামাজিক ব্যাধি নয়, দণ্ডনীয় অপরাধও।
৫ জুন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮ বছরের কম বয়সে বাল্যবিবাহের হার ২০০৬ সালে ৬৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ৫২ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ৫১ শতাংশ ছিল। সেই হিসাবে দেশে এখন ৪ কোটি ১৫ লাখ মেয়ে ও নারী বিবাহিত এবং সন্তানের মা। বাল্যবিবাহ কেবল একটি মেয়ের জীবনকেই ধ্বংস করে না, উত্তর প্রজন্মকেও তার দায় বহন করতে হয়।
গত ১০ বছরে বাল্যবিবাহ কমার যে হার দেখা যাচ্ছে, সে হার দ্বিগুণ হলেও ২০৩০ সালে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার হবে প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ নির্মূল করা। ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্রিস্টিন ব্লুখুস বলেছেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ শতাংশ হারে বাল্যবিবাহ কমছে। এই হারে কমলে বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ দূর করতে সময় লাগবে ২১৫ বছর।
এখন প্রশ্ন হলো, সরকার কি ২ শতাংশ হারে বাল্যবিবাহ কমিয়ে ২১৫ বছর অপেক্ষা করবে, না টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাবে? মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি বলেছেন, সরকারের একার পক্ষে বাল্যবিবাহ নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাঁর এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত না করেও প্রশ্ন করতে চাই, সরকার কি তার লক্ষ্য পূরণে সচেষ্ট? আরও অনেক সমস্যার মতো বাল্যবিবাহ রোধেও সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একধরনের আত্মসন্তুষ্টি লক্ষ করা যাচ্ছে। না হলে বাল্যবিবাহ রোধে আমরা এতটা পিছিয়ে থাকব কেন? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ করোনাকালের উদাহরণ টানেন। কিন্তু করোনার প্রকোপ তো দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের ওপরই পড়েছিল। তারা উত্তরণ ঘটাতে পারলে আমরা কেন পারলাম না?
বাল্যবিবাহ রোধে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নেওয়া এবং সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে যুক্ত করার বিকল্প নেই। ওই অনুষ্ঠানে এক মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর বক্তব্য আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তিনি তাঁর বড় বোনের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে মা–বাবাকে রাজি করিয়েছেন। এ রকম আরও অনেক তরুণ এগিয়ে এলে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সামাজিক জাগরণ তৈরি হবে।
বাল্যবিবাহ রোধ আন্দোলনটি শুরু হতে হবে পরিবার থেকেই। কোনো অভিভাবক যাতে ১৮ বছরের আগে মেয়েকে বিয়ে দিতে না পারেন, সে বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন, কাজি, জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষকদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা আইনভঙ্গ করে বাল্যবিবাহ দেবেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বাল্যবিবাহের কারণে এলাকায় কেউ শাস্তি পেলে অন্যরা এই কাজ করতে সাহস পাবেন না।
আশা করি, সরকার বাল্যবিবাহ রোধে ২১৫ বছর অপেক্ষা করবে না। ২০৩০ সালের মধ্যে না পারলেও অন্তত তারা ২০৪১ সালের মধ্যে যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে, তার মধ্যে দেশকে বাল্যবিবাহমুক্ত করুক।