রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিচালনা কমিটি চাই

সম্পাদকীয়

সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রবিধানমালা সংশোধন করতে যাচ্ছে বলে প্রথম আলোয় খবর এসেছে। সংশোধনী প্রস্তাবটি হলো, পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে যাঁরা আসবেন, তাঁদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে উচ্চমাধ্যমিক পাস। বর্তমানে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো মাপকাঠি নেই।

কিন্তু এটাও গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতো হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বহু বছর ধরেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে প্রকৃত শিক্ষানুরাগীদের আনার কথা শোনা যাচ্ছিল। নানা সংশোধনীর পরও উদ্দেশ্য সফল হয়েছে—এমনটি বলা যাবে না।

দেশে বর্তমানে মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ৩৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে নতুন ২ হাজার ৭১৬টিসহ মোট এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৯ হাজার ১৬৪টি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি হয় ১১ থেকে ১৪ সদস্যের। এর মধ্যে একজন চেয়ারম্যান বা সভাপতি থাকেন।

এ ছাড়া শিক্ষকদের মধ্যে দুজন নির্বাচিত সদস্য ও একজন সংরক্ষিত নারী সদস্য (শিক্ষক), শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মধ্য থেকে চারজন নির্বাচিত সদস্য ও একজন নারী সদস্য, একজন নির্বাচিত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, একজন দাতা সদস্য এবং প্রতিষ্ঠানপ্রধান সদস্যসচিব হিসেবে থাকেন। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের কমিটিও প্রায় কাছাকাছি ধরনের।

পরিচালনা কমিটি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কমিটির যাঁরা প্রধান হন, তাঁরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ আছে। ২০০৯ সালের প্রবিধানমালা অনুযায়ী, একজন সংসদ সদস্য তাঁর নির্বাচনী এলাকার সর্বোচ্চ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতি হতে পারতেন।

২০১৬ সালে ওই প্রবিধানমালার কিছু অংশ অবৈধ ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। ফলে সংসদ সদস্যরা নিজ নির্বাচনী এলাকায় চাইলেও সভাপতি হতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা সভাপতি না হলেও তাঁদের আত্মীয়স্বজন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও অনুগতদের কমিটিতে ঢুকিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাববলয়ে রাখার চেষ্টা করেন। কেবল সংসদ সদস্য নন, একই কাজ করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও।

মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার ধরাবাঁধা নিয়ম না থাকায় শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক নেই—এমন ব্যক্তিরাও ওই পদে বসে শিক্ষকদের ওপর ছড়ি ঘোরান। এক বছর আগে নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করা হয়। কলেজটির পরিচালনা কমিটির (গভর্নিং বডি) সভাপতি নড়াইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ঘটনার পর তিনি ভুক্তভোগী শিক্ষকের পাশে দাঁড়াননি।

যে উদ্দেশ্যে সংসদ সদস্যদের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব ও চাপের কারণে শিক্ষকেরাও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। বিস্ময়কর হলো, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ ‘বহিরাগত’। তাঁরা এলাকায় থাকেন না, ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে চলছে, সেসব নিয়েও তাঁদের মাথাব্যথা থাকে না।

যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে, সেই দলের নেতা-কর্মী ও তাঁদের আস্থাভাজনেরা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসবেন, শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কল্যাণের চেয়ে তাঁরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থকে বড় করে দেখবেন, এটা চলতে দেওয়া যায় না। যদি সরকার সত্যি সত্যি বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান উন্নয়ন চায়, সভাপতির ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিরূপণের পাশাপাশি পরিচালনা কমিটিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।