গণমানুষের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন

সম্পাদকীয়

বর্তমান অর্থবছরের শুরু, অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে দেশে যা হচ্ছে, সেটা যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি গভীর উদ্বেগজনক। এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও চলছে অচলাবস্থা। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েও ফের স্থগিত রেখেছে। এইচএসসি পরীক্ষাও ১০ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত আছে।

তবে গত এক মাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য। শিল্পকারখানা কিছুদিন বন্ধ থাকার পর চালু হলেও শিক্ষার্থীদের অব্যাহত আন্দোলন বিস্তৃত হওয়ায় নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি তৈরি পোশাক রপ্তানি ও প্রবাসী আয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ডলার–সংকট ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সরকারিভাবে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় ১১৭ টাকা ধার্য করা হলেও বাইরে ১২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকারের নেওয়া হঠকারী ও বিলম্বিত সিদ্ধান্ত সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আন্দোলনকেন্দ্রিক সহিংসতায় ইতিমধ্যে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ও কয়েক হাজার লোকের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা নজিরবিহীন।

সরকার এক পর্যায়ে কারফিউ জারি করে কিংবা সেনা মোতায়েন করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। যেখানে যত বেশি শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেখানে তত বেশি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে এখন সর্বস্তরের মানুষ যুক্ত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শনিবার বিকেলে যে জমায়েত হয়েছে, তার বার্তা সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ ধরনের সর্বব্যাপী প্রতিবাদ বলপ্রয়োগ করে দমন করা যায় না।

শিক্ষার্থীরা আজ রোববার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দিয়েছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রোববার জমায়েত ও সোমবার শোক মিছিলের কর্মসূচি নিয়েছে। দুই পক্ষের ওই মুখোমুখি কর্মসূচি পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলতে পারে। অতএব বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত বলে আমরা মনে করি। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না।

শনিবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে যে সিদ্ধান্তই হোক না কেন, সরকার বলপ্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মোকাবিলা করতে গেলে পরিস্থিতি আরও সংঘাতময় হয়ে উঠবে। এ রকম কিছু করা হবে আত্মঘাতী।

সরকারকে আন্দোলনকারী মানুষের ভাষা ও দেয়ালের লিখন পড়তে হবে। তাদের এই আন্দোলন যত দিন কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমিত ছিল, তত দিন সমস্যার সমাধান অনেক সহজ ছিল। কিন্তু সরকার সেই পথে না গিয়ে পরিস্থিতি আরও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, আন্দোলনটি আর কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমিত নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার। এসব মৌলিক অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত রেখে বর্তমান সমস্যার সমাধান খোঁজা হবে বৃথা চেষ্টা।

সরকার যদি জাগ্রত জনতার ভাষা বুঝতে পারে, তাহলে আরও প্রাণহানি, আরও সম্পদহানি, আরও অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দেশ ও জনগণ রক্ষা পেতে পারে। সরকার যেই পদক্ষেপই নিক না কেন, সেটা নিতে হবে শিক্ষার্থীদের আস্থায় নিয়ে।