২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে কেন এই ছেলেখেলা

সম্পাদকীয়

দায় না নেওয়ার সংস্কৃতি এবং গোষ্ঠীস্বার্থ যে কত বড় বিপর্যয় ঘটাতে পারে, তার বড় একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। মঙ্গলবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সেটি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সটি চার বছর আগেই ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ অগ্নিদুর্ঘটনার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা দেয়।

সতর্ক করে দশবার নোটিশও দেওয়া হয়। এরপরও সিটি করপোরেশন, মালিক সমিতির কেউ সেই সতর্কতাকে আমলে নেয়নি। এখন ঈদের আগে পাঁচ হাজার ব্যবসায়ী নিঃস্ব হলেন, প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সম্পদহানি হলো, কয়েক হাজার কর্মচারীর ভবিষ্যৎ রুটি-রুজি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল—এর দায় কে নেবে?

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, মালিক সমিতি কিংবা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কেউ এ অগ্নিকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তাদের কাজটি করেছে, কিন্তু সেটা কার্যকর করার দায়িত্ব যেসব সংস্থার ওপর, তারা কেন এত বড় ঝুঁকিকেও পাত্তা দিল না?

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দায় চাপাচ্ছে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের মালিক সমিতির ওপর। তারা বলছে, কমপ্লেক্সের পুরোনো ভবনগুলো ভেঙে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মালিক সমিতি আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসায় সেটা করা সম্ভব হয়নি। সিটি করপোরেশনের এ দায়সারা বক্তব্য কি কোনো অর্থ বহন করে? এতগুলো মানুষের জানমালের নিরাপত্তা যেখানে জড়িত, সেখানে তারা কেন আইনিভাবে মোকাবিলা করেনি?

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে ১৯৯৫ ও ২০১৮ সালে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কাঠ ও টিনের তৈরি অবকাঠামো ও ঘিঞ্জি পরিবেশ এমনিতেই দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর আবার দোতলার অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও বিপণিবিতানগুলো তিনতলা করা হয়েছে। অনুমোদনের চেয়ে দ্বিগুণ দোকান করা হয়েছে। এসব অনিয়মের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে বিরোধ নেই। দোকানমালিক সমিতির কিছু নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থে এতগুলো মানুষ কেন নিঃস্ব হবেন?

অগ্নিকাণ্ডটি ঘটেছে ঢাকার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে, এর খুব কাছেই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং পুলিশের সদর দপ্তর অবস্থিত। প্রাথমিক পর্যায়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হওয়ায় এর ব্যাপ্তি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছায়। ঢাকা ও আশপাশের তিন জেলার ২২টি স্টেশনের ৪৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাব ও আনসার সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার কাজে অংশ নেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টার পরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সাড়ে ছয় ঘণ্টা লেগে যায়, আশপাশের ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, উৎসুক জনতা, পানির অভাব ও বাতাসের বেগ—এ তিন কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে এতটা দেরি হয়েছে। বঙ্গবাজারের এক কিলোমিটারের মধ্যে এক দশক আগেও ছয়টি বড় খাল ছিল। সেই খালগুলো ভরাট করে ফেলায় ফায়ার সার্ভিস প্রয়োজনীয় পানি পায়নি। ২০১৯ সালে ঢাকার বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সুপারিশ এসেছিল ঢাকায় কিছু দূর পরপর ফায়ার হাইড্র্যান্ট স্থাপনের। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেই সুপারিশ কাগজেই আটকে রয়েছে।

বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে সিটি করপোরেশন, রাজউক কিংবা রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলো কি কোনো শিক্ষা নেবে? ভবনধস, অগ্নিকাণ্ড, গ্যাস বিস্ফোরণের একের পর এক ঘটনা প্রমাণ করছে রাজধানী ঢাকা বসবাসের জন্য কতটা অনিরাপদ। গত ১১ মার্চ ডেইলি স্টার–এর এক খবর জানাচ্ছে, ঢাকার ১৯টি কাঁচাবাজার ১৬ বছর আগে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে সিটি করপোরেশন।

প্রশ্ন হলো, শুধু ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দিলেই কি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল? রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা অপসারণে কার্যকর পদক্ষেপ কে নেবে? নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে কেন এই ছেলেখেলা?