এখনই লাগাম টেনে ধরুন

সম্পাদকীয়

শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়নি, এটা খুবই স্বস্তির খবর। কিন্তু অর্থনীতির যেসব সূচক একটি দেশকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, তা থেকে আমরা নিরাপদ দূরত্বে আছি, সে কথাও বলা যাবে না। বিশেষ করে আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খল অবস্থায় সরকারের নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ ফেলার কথা।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর খেলাপি ঋণের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা অবশ্য উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের বিষয়টি বহু বছর ধরে আলোচনায় আছে। নির্বাচনের আগে সব দলই খেলাপি ঋণ কমানো ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু নির্বাচনের পর হয় তার উল্টো। গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ শাসনামলে খেলাপি ঋণ কয়েক গুণ বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটির খেলাপি ঋণ প্রায় ১১ শতাংশ। এরপরই অবস্থান বাংলাদেশের, খেলাপি ঋণ প্রায় ৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণের দেশ নেপাল। দেশটির খেলাপি ঋণ ২ শতাংশের কম। ভারতের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ, মালদ্বীপে ৬ শতাংশের কম, পাকিস্তান ও ভুটানের ৮ শতাংশের কম। তদুপরি শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে, যথাক্রমে—উচ্চ আমদানি ব্যয়, ঋণগ্রহীতাদের নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেড়েছে। পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ ইত্যাদি ধরলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি হবে। আইএমএফের হিসাব অনুসরণ করলে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।

গত জানুয়ারিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে, তার অন্যতম শর্ত ছিল ব্যাংক খাতে খেলাপি
ঋণের হার কমাতে হবে। সম্প্রতি আইএমএফের প্রতিনিধিদল এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলেও সরকারের পক্ষ থেকে ‘হবে, হচ্ছে’ বলে কিছু অনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। দু–একটি ছাড়া বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অবস্থা নাজুক।

অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালকেরাই নিয়মবহির্ভূতভাবে কোটি কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের দৌরাত্ম্য কমাতে সরকার আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার শামিল। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হলেও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটেনি।

ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো রাজনৈতিক প্রভাব–প্রতিপত্তি কাজ করে। কোভিড ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষও উচ্চ মূল্যস্ফীতির শিকার, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না।

বহির্বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন করণীয় না থাকলেও তারা অন্তত আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান নিতে পারে। ঋণগ্রহীতারা যদি নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবেন কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি হয়েও পার পেয়ে যান, সরকারের কোনো আইন ও পদক্ষেপই কাজে আসবে না।