অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে

সম্পাদকীয়

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে দেশে অনেক আইন আছে। নারীর সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সরকারি–বেসরকারি অনেক সংস্থা কাজও করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এত সব উদ্যোগ–আয়োজন সত্ত্বেও নারী নির্যাতন কমছে না। বরং সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

আমাদের সমাজে ঘরে–বাইরে কোথাও নারী নিরাপদ নন। তাঁরা ঘরে যেমন পুরুষ সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন, তেমনি বাইরেও। বিশেষ করে যানবাহন ও কর্মস্থলে নারীকে প্রায়ই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণের ঘটনাও বেড়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর যৌতুক, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ ও অপহরণ ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নারী নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৬টি, অন্যগুলো শিশু নির্যাতনের অভিযোগে। নারী নির্যাতনের মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ২৪ হাজার ৩৩৯ জনকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৮৩৫ জনকে। অর্থাৎ ওই ৯ মাসে প্রায় ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসামি গ্রেপ্তার হননি।

এখানে নারী নির্যাতনের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, প্রকৃত অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। পারিবারিক সম্মান রক্ষা ও সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয় থেকে অনেকে মামলা করেন না। বিশেষ করে ভুক্তভোগী অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কিংবা অপরাধীরা সবল হলে মামলা প্রত্যাহারের জন্য নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়, যা উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। এসব মামলার বিচারের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো তদন্তে নিয়োজিত ব্যক্তিদের গাফিলতি। মনে রাখতে হবে, সমাজে অপরাধ তখনই কমে, যখন সেই অপরাধীর বিচার হয়।

এ বছর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধপক্ষের প্রতিপাদ্য হলো ‘নারী-কন্যার সুরক্ষা করি, সহিংসতামুক্ত বিশ্ব গড়ি’। নারী ও কন্যাশিশুর সুরক্ষার দায়িত্ব কেবল নারীর নয়, এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষকেও। অপরাধের বিচার হওয়ার পূর্বশর্ত হলো মামলা করা এবং অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা। কিন্তু আসামিদের যদি গ্রেপ্তারই করা না যায়, তাহলে শাস্তি হবে কী করে? গ্রেপ্তার করার পরও অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি তদন্তে গাফিলতি করেন, অপরাধীরা বেকসুর খালাস পেয়ে যান। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে দেখা যায়, মামলা হলেও ৬৮ শতাংশ আসামি গ্রেপ্তার হন না। যাঁরা গ্রেপ্তার হন, তাঁদেরও বড় অংশ আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসেন।

নারীর প্রতি সহিংসতা কেবল অপরাধ নয়, সামাজিক ব্যাধিও। সহিংসতার ঘটনা কেবল নারীর জীবনকেই বিপন্ন করে না; রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অগ্রগতিতে বাধা দেয়। নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।

নারী নির্যাতন বন্ধে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে অপরাধ সংঘটিত না হতে পারে, সে বিষয়েও আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

আনুষ্ঠানিকভাবে পক্ষ পালন বা স্লোগানে নারী নির্যাতন কমবে না। আবাসস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবহন কিংবা কর্মস্থলে যাতে নারী নির্যাতনের ঘটনা না ঘটে, এসব বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা পুরোপুরি প্রতিপালিত হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এ জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। প্রয়োজনে নারী নির্যাতককে সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে।