জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের বিজয়ের সাড়ে চার মাস পার হলেও সব নিহত ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে এবং আহত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা দিতে না পারার ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা—উত্তরাঞ্চল সফরে গেলে আন্দোলনে ঠাকুরগাঁওয়ের আহত ব্যক্তিরা সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে তাঁকে জানানো হয়।
এর আগে প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গণ-অভ্যুত্থানে নিহত অনেককে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে দাফন, পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা কম। রায়েরবাজার কবরস্থানেই বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় ১১৪টি মরদেহ। তাঁদের অনেকে গণ-অভ্যুত্থানে নিহত।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ-সংলগ্ন কবরস্থানে প্রতিটি কবরে একটি করে নামফলক আছে। তাতে দাফন করা মরদেহের নাম-পরিচয় লেখা রয়েছে। কিন্তু কবরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকে ওই রকম কোনো নামফলক নেই। একটু পরপর ছোট ছোট বাঁশ পুঁতে রাখা আছে। কেউ বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই যে সেগুলো ‘বেওয়ারিশ’ লাশের কবর। এই কবরগুলোতে যাঁরা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন, তাঁদের সবার পিতৃপরিচয় ছিল, ছিল তাঁদের পরিবার। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের কারণে তাঁরা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়েছেন।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের হিসাব অনুযায়ী, রায়েরবাজার কবরস্থানে মাসে গড়ে ৪৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। তবে জুলাই মাসে সংখ্যাটি বেড়ে ৮০ হয়ে যায়।
অনেক পরিবারের সদস্য আঞ্জুমান মুফিদুলে খোঁজ নিয়ে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া সদস্যের নাম জানতে পারলেও তাঁদের কবর বের করতে পারছেন না বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়ায়। ডিএনএ টেস্ট করলে জানা যাবে কার স্বজনের লাশ কোনটি। কিন্তু বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। গণ-অভ্যুত্থানে নিহত সোহেল রানার মা রাশেদা বেগম ও মাহিন মিয়ার ভাই আবদুল জব্বার জানিয়েছেন, তাঁরা কেবল জানতে চান কোনটি তাঁদের সন্তান বা ভাইয়ের কবর।
এখন পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশিত না হওয়াও দুর্ভাগ্যজনক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে নিহত ৮৬০ জনের পরিচয় প্রকাশ করা হয়।
‘গণ–অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল’ গঠন করেছে সরকার। ১০ নভেম্বর এই সেলের এক গণবিজ্ঞপ্তিতে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে নিহত, নিখোঁজ, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত অথবা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে অন্য কোনোভাবে মারা গেছেন, তাঁদের স্বজনদের তালিকায় নাম লেখাতে অনুরোধ জানানো হয়।
নিহত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা করা হলে সেটির দায়িত্ব পড়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ‘ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি’র ওপর। এই পরীক্ষাগারের প্রধান ও ডেপুটি চিফ ডিএনএ অ্যানালিস্ট আহমাদ ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যাত্রাবাড়ীর চারটি এবং সিরাজগঞ্জের দুটি পুড়ে যাওয়া মৃতদেহের ডিএনএ প্রোফাইল করার আবেদন তাঁরা পেয়েছেন। দুটি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। অন্যগুলোর দাবিদার আসেননি।
এত দিন পরও জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের কবর চিহ্নিত না হওয়া কিংবা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দিতে না পারা সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতারই পরিচয়। দ্রুত নিহত ব্যক্তিদের কবর চিহ্নিত না হলে ভবিষ্যতে এটা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বেওয়ারিশ লাশের কবর দুই বছরের বেশি রাখা হয় না। যেসব মানুষ গণ–অভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন, তাঁদের স্বজনেরা, কবরটি চিহ্নিত করার অধিকার নিশ্চয়ই রাখেন।
আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবার বিষয়ে একজন উপদেষ্টা যা বলেছেন, সেটাও পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। চিকিৎসার দায়িত্ব জুলাই ফাউন্ডেশনের হলেও তারা কাজটি ঠিকমতো করছে কি না, সেটা তদারক করতে হবে সরকারকেই।