প্রতিটি হত্যার ঘটনায় বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হোক

সম্পাদকীয়

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, তার ন্যায়বিচার ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। আমরা জানি যেসব মানুষ মারা গেছেন, কোনো বিচার বা ক্ষতিপূরণই তাঁদের ফিরিয়ে আনতে পারবে না; তবে ন্যায়বিচার হলে স্বজনেরা কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি দেশের নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিটি হত্যার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। হত্যা বা যেকোনো অপরাধের বিচারের জন্য সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত হওয়া জরুরি।

এই প্রেক্ষাপটে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হত্যার ঘটনাগুলোকে এমনভাবে চিত্রায়িত করছে, তাতে এসব ঘটনার বিচার হওয়া সম্ভব নয়। তাদের ভাষ্য সংবাদমাধ্যম, প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের বর্ণনার বিপরীত।

রাজধানীতে বিক্ষোভকালে নিহত ৬৪ জনের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় বলা হয়, মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেছে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে। প্রথম আলো পুলিশ বাদী হয়ে করা ৩৪টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করেছে। পুলিশের মামলার বাইরে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে, যার নথিতে বাদী হিসেবে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের নাম রয়েছে। প্রথম আলো ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, তাঁরা মামলা সম্পর্কে কিছু জানেন না। লাশ আনার সময় তাঁদের কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নেওয়া হয়েছে। পুলিশ স্বজনদের কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নিয়ে যদি পরে সেটিকে মামলা হিসেবে উপস্থাপন করে, সেটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সংঘাতে গত ১৬ জুলাই থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অন্তত ২১২ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও সরকার ১৫০ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, বাসার ভেতরে ও ছাদে থাকা মানুষও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। মারা গেছেন সাংবাদিক, পথচারী ও ফুটপাতের হকারও। কদমতলীতে তিন বছরের শিশু আবদুল আহাদ নিহত হওয়ার ঘটনায় ২৮ জুলাই থানায় মামলা করে পুলিশ। যাত্রাবাড়ীতে ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসান। দুটি ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের আসামি করেছে। রংপুরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হয়েছেন খুব কাছ থেকে পুলিশ সদস্যের ছোড়া গুলিতে, যা বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজেও উঠে এসেছে। কিন্তু পুলিশ সেই ঘটনায় ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে আসামি করে জেলে পাঠায়।

গয়রহ মামলার পাশাপাশি সারা দেশে ব্লক রেইড করে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই তরুণ ও অল্প বয়সী। একদিকে তাঁরা অজ্ঞাতনামা আসামি করছেন, অন্যদিকে তদন্ত ছাড়া হাজার হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকানো হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের জানার কথা, অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই যুগে কেউ চাইলেও সত্য আড়াল করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক যথার্থই বলেছেন, দেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা বিরোধী রাজনৈতিক দল ও মতের মানুষদের দমন করার অন্যতম প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

 অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা ও গণগ্রেপ্তার যেমন নিরীহ মানুষকে হয়রানি ও নির্যাতনের দিকে ঠেলে দেবে, তেমনি ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করবে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হোক।