কারখানা বন্ধ করে আন্দোলন নয়

সম্পাদকীয়

শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা ও অশান্তি যেন কাটছেই না। দুই সপ্তাহ ধরে শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের অনেক শিল্পকারখানায় উৎপাদন বন্ধ আছে। বৃহস্পতিবার কেবল আশুলিয়া এলাকায় ২১৯টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। ৩১ আগস্টের পর অন্তত ছয়টি জেলায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। বিভিন্ন কারখানার সামনে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, িটফিন বিল বৃদ্ধি, বেতনসহ সমানুপাতিক হারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকেরা।

বুধবার বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুরে বেক্সিমকোর বিগবস কারখানার শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন এবং একপর্যায়ে তাঁরা কারখানার গুদামে আগুন ধরিয়ে দেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন কিছু শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করা হলেও বেশির ভাগ ছিলেন বঞ্চিত। এতে ক্ষুব্ধ হয়েই শ্রমিকেরা কারখানার গুদামে আগুন লাগিয়ে দেন। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের এক সাবেক মন্ত্রীর টায়ার কারখানায়ও একাধিকবার আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে কয়েকটি কারণ উঠে আসছে সংবাদমাধ্যমগুলোতে। আওয়ামী লীগ সরকার ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কারখানামালিকদের অনেকে সরকার পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের কারখানাগুলোর শ্রমিকদের বেতন–ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। আশুলিয়ায় অস্থিরতার পেছনে থাকতে পারে ঝুট ব্যবসাকেন্দ্রিক বিরোধ। আগে সেই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এখন সেই ব্যবসা দখল নিতে চায় তাদের বিরোধীপক্ষ। কোনো কোনো শ্রমিকনেতা মনে করছেন, তৃতীয় কোনো পক্ষ শ্রমিক অস্থিরতায় ইন্ধন দিচ্ছে। মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা বলছেন, আগের যেকোনো শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় নির্দিষ্ট দাবিদাওয়া ছিল। এবার ‘অযৌক্তিক’ দাবির দিকে ঝুঁকে একটি পক্ষ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। একেক কারখানার শ্রমিকেরা একেক ধরনের দাবিদাওয়ার কথা জানাচ্ছেন। অনেক দাবি মালিকেরা মেনেও নিয়েছেন। এরপরও বিক্ষোভ থামছে না।

শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে বুধবার শ্রম মন্ত্রণালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়, যার মধ্যে রয়েছে ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনা, বকেয়া বেতন–ভাতা দ্রুত পরিশোধ, শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণে কমিটি গঠন। বৃহস্পতিবার ন্যাশনাল বিজনেস ডায়ালগে ব্যবসায়ীরা শিল্পাঞ্চলে ভাঙচুর ও লুট বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ও ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একজন ব্যবসায়ী নেতা সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান। উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করার আশ্বাস দেন।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, কেবল প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন করা যাবে না। তাঁদের ন্যূনতম ন্যায্য মজুরির পাশাপাশি সুন্দর ও নিরাপদ কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় পক্ষের কোনো ইন্ধন থাকলে তা অনুসন্ধান করে দেখা হোক। পর্যালোচনা কমিটি দ্রুত কাজ শুরু করলে শ্রমিকদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে আশা করা যায়। গত সোমবার বিজিএমইএর কার্যালয়ে বৈঠক করে আশুলিয়া অঞ্চলের শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এটা ইতিবাচক।

তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এর ওপর লাখো শ্রমিকের জীবন–জীবিকা নির্ভরশীল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কোনো অসন্তোষ দেখা দিলে প্রতিযোগী রপ্তানিকারক দেশগুলো এর সুযোগ নেবে। ইতিমধ্যে কেউ কেউ সেই চেষ্টা চালাচ্ছে বলে পত্রিকান্তরে জানা গেছে। অতএব সরকারকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্রুত শিল্পাঞ্চলে শান্তি ও নিরাপদ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। শ্রমিকদেরও বুঝতে হবে, কারখানা বন্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিজেদেরও ক্ষতি হবে। আন্দোলন হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস। কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে দেওয়া যাবে না।