যেকোনো সরকারের নীতি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনপ্রশাসনের ভূমিকা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজনৈতিক সরকারে ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরাও অনেক সময় তঁাদের নীতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করে থাকেন। কিন্তু অরাজনৈতিক সরকারে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা–কর্মচারীরাই একমাত্র ভরসা।
উদ্বেগের বিষয় হলো, ৫ আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সেই জনপ্রশাসনে একধরনের অস্থিরতা চলছে। সম্প্রতি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ–সংক্রান্ত একটি খবর সেই অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জনপ্রশাসনে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডার এবং ৫০ শতাংশ অন্যান্য ক্যাডার থেকে নেওয়ার সুপারিশ করছে সংস্কার কমিশন। এত দিন প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ নেওয়া হতো। খবরটি চাউর হওয়ার পর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এমনকি তাঁরা কমিশন চেয়ারম্যানের পদত্যাগও দাবি করেছেন। অন্যদিকে ২৫তম ক্যাডারের কর্মকর্তারা আগে থেকেই কলমবিরতিসহ কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন।
এ অবস্থায় জনপ্রশাসনে যে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাঁদের দাবি নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সরব বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কঠোর বার্তা দিয়েছে। এতে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মচারী বিভিন্ন দাবি নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, কলমবিরতিসহ বিবিধ কর্মসূচি পালন করছেন। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত, আদেশ বা সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার আগেই সে বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরূপ মন্তব্যসহ বিবৃতি প্রকাশ করা হচ্ছে; যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার পরিপন্থী। সরকারি কর্মচারী বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে ইতিমধ্যে সরকার কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার প্রতি কঠোর বার্তা বলে ধারণা করি।
কীভাবে জনসেবা বাড়ানো যাবে, সেটা খুঁজে বের করাই ছিল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠনের লক্ষ্য। কিন্তু এখানে ক্যাডারের দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে এসেছে, যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মাঠে নামা কিংবা হুমকিধমকি দেওয়া অগ্রহণযোগ্য। আবার ২৫তম ক্যাডারের কর্মকর্তারাও দাবিদাওয়া নিয়ে যেভাবে কর্মসূচি দিয়ে প্রশাসনকে অচলাবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন, সেটাও সমর্থনযোগ্য নয়।
বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে চাওয়া–পাওয়ার দ্বন্দ্ব থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেটা সমাধান করতে হবে আইনি উপায়ে, নিয়মের মধ্যে থেকে। সরকারকে হুমকি–ধমকি দিয়ে নয়। সরকারের নীতনির্ধারকদেরও উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব বিবদমান ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করা। প্রশাসনের এই অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেবাপ্রার্থী জনগণ। যাঁদের করের অর্থে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেতন–ভাতা নেন, তাঁদের বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই।