ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পেরিয়েছে। এ সময়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শ্রমিক, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষকে আমরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করতে দেখছি। সরকারি হিসাবেই ঢাকা ২ কোটি ১০ লাখ মানুষের শহর। আর বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। এমন একটি নগরে কোনো সড়ক বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আন্দোলন চললে কী যে নরক গুলজার অবস্থায় পড়তে হয়, তা নাগরিকমাত্রই হাড়ে হাড়ে টের পান; যার সর্বশেষ নজির আমরা দেখতে পেলাম গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করার ঘটনায়।
সড়ক বন্ধ করে কর্মসূচি পালন করা কিংবা দাবিদাওয়া জানানোর রেওয়াজ দেশে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। রাজনৈতিক দলগুলোই এ কাজের পথপ্রদর্শক। যে নাগরিকদের অধিকার আদায়ের কথা বলে এসব কর্মসূচি পালন করা হয়, তাঁদের ভোগান্তি, দুর্ভোগ আর অসুবিধার বিষয়গুলো রাজনৈতিক নেতারা কোনো সময়ই আমলে নেন না। সমাজের অন্য অংশের লোকেরাও তাঁদের দাবি আদায়ে একই পথ অবলম্বন করেন।
যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজে নাগরিকের বিভিন্ন অংশের মধ্যে দাবিদাওয়া থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই দাবিদাওয়া জানানোর রীতিসিদ্ধ পথও আছে। সেটা হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও আইনসম্মত উপায়ে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমরা এর উল্টো চর্চাটাই দেখছি। যুক্তিবোধের চেয়ে সেখানে আবেগের প্রাধান্যটা বেশি দৃশ্যমান।
এটা সত্যি যে বিগত সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বৈষম্য ও বঞ্চনার পাহাড় জমে উঠেছিল। কিন্তু তাই বলে সবাই একসঙ্গে সড়কে নেমে যান চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে? আমরা দেখেছি, পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল যে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও সচিবালয়ের আশপাশে বিক্ষোভে নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়েছে। জনভোগান্তি দূর করতে শাহবাগের পরিবর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা-সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি যে হয়নি, তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তার দৃষ্টান্ত।
ঢাকার সাত কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্তটি ছিল কোনো ধরনের বিচার-বিবেচনা ছাড়াই ব্যক্তির ইচ্ছার বাস্তবায়ন। ফলে কলেজ সাতটির শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। পরীক্ষা, ফলাফলসহ বিভিন্ন দাবিতে তাঁদের আন্দোলন করতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সমাধানের জন্য ১৩ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করে। কমিটি কী সিদ্ধান্ত দেয়, তার জন্য অপেক্ষা করাটাই যৌক্তিক। কিন্তু এর মধ্যেই তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের জন্য আন্দোলন শুরু করেন।
তাঁরা ঢাকার যোগাযোগ নেটওয়ার্কের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র মহাখালীতে সড়ক অবরোধ করে দুই দফায় বিক্ষোভ করেন। এতে পুরো শহর স্থবির হয়ে পড়ে। রেলপথ অবরোধ করায় কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে ট্রেন চলাচল। চলন্ত ট্রেন থামাতে গিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী পাথর ও ইট ছুড়ে মারেন। এতে নারী, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত হন। এটা অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমরা সহনশীল ও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি।
আমরা মনে করি, তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের উচিত তাঁদের দাবিদাওয়া ছাত্র প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকারের কাছে উত্থাপন করা। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, সে ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে যেন আর না ঘটে, তার জন্য সরকারেরও দ্রুত সাড়া দেওয়ার অনুশীলন জরুরি। সবার মনে রাখা প্রয়োজন, আলাপ-আলোচনায় যেকোনো সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম পথ। জনদুর্ভোগ বন্ধে সরকারকে অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।