একটি প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ না হলে দেশবাসীকে কেবল অর্থদণ্ডই দিতে হয় না, জীবনদণ্ডও যে দিতে হয়, তার প্রমাণ ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ বা ভাসমান জেটি নির্মাণ। এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট। এরপর চার দফা মেয়াদ বাড়ে ও ব্যয় ৫ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ৮ হাজার ২৯৮ কোটিতে উন্নীত হয়।
নির্মাণকাজ শেষে গত বছরের জুলাইয়ে প্রথমবারের মতো সাগরের তলদেশে পাইপলাইনে তেল খালাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন
জাহাজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পারায় তেল খালাসের সংযোগকারী ভাসমান পাইপ ছিঁড়ে যায়। এরপর চীন থেকে টাগবোট এনে ওই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয়বার পরীক্ষামূলকভাবে তেল খালাসের উদ্যোগ সফল হয়। কিন্তু তদারকি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি না হওয়ায় তেল খালাসের কাজ আটকে যায়।
এ অবস্থায় সনাতন পদ্ধতিতে ছোট ট্যাংকারে তেল সরবরাহ করার কারণে ইতিমধ্যে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) তেল পরিবহনের ট্যাংকার ‘এমটি বাংলার জ্যোতি’ থেকে তেল খালাসের সময় বিস্ফোরণ থেকে আগুন লেগে তিনজন নিহত হন। এর আগেও দুর্ঘটনায় একজন মারা যান। জেটি ও ট্যাংকারে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা নেই, নেই গ্যাস চিহ্নিতকরণ ব্যবস্থাপনাও।
ভাসমান জেটি নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় মহেশখালী দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে গভীর সাগরে ভাসমান মুরিং (বিশেষায়িত বয়া) বসানো হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশ দিয়ে মহেশখালী স্টোরেজ ট্যাংক হয়ে আবার পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত ১১০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় পাম্পিং স্টেশন, তিনটি করে অপরিশোধিত তেল ও ডিজেল ট্যাংক, বুস্টার পাম্প, জেনারেটর নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রকল্পটির নির্মাণ (ইপিসি) ঠিকাদার ছিল চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিপিইসি)। এর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকাদার হিসেবে সিপিপিইসিকে নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে গেলেও গত সরকারের আমলে চুক্তি হয়নি।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিন উল আহসান জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছিল। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনটি স্থগিত করা হয়েছে। সরকারি ক্রয়নীতির আওতায় শিগগিরই ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
প্রশ্ন হলো বিদায়ী সরকারের আমলে প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও তারা তদারকি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করল না কেন? এর পেছনে অন্য কোনো মতলব ছিল কি না, খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজের সময় বাড়ানো হতো বাড়তি অর্থ ব্যয়ের জন্য। প্রকল্পের সময় যত প্রলম্বিত হতো, ব্যয়ও তত বেড়ে যেত। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও সে রকম কিছু হয়নি তা কে বলতে পারে?
এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারকে দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, নতুন করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই পাইপলাইনে তেল সরবরাহের ব্যবস্থা করা। ৩০ সেপ্টেম্বরের দুর্ঘটনার পর গঠিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনেও ভাসমান পাইপে তেল সরবরাহ দ্রুত চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে বিশাল অঙ্কের টাকার এই প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা।