২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সর্বজনীন পেনশন-পদ্ধতি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ১৫ বছর পর হলেও সেটি আলোর মুখ দেখছে, এটা সুসংবাদই বলতে হবে। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে পেনশন-সুবিধার আওতায় আনা হবে।
কিন্তু ১০ কোটি মানুষ, অর্থাৎ কর্মক্ষম প্রত্যেক নারী ও পুরুষকে এই কর্মসূচির আওতায় কীভাবে আনা হবে, তা এখনো অস্পষ্ট। চারটি আলাদা স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে যথাক্রমে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে।
এর মধ্যে আছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য প্রবাস; বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি; রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সমতা স্কিম।
বাকি দুটির একটি শ্রমিকশ্রেণির জন্য, অপরটি শিক্ষার্থীদের জন্য। পর্যায়ক্রমে সরকারি কর্মচারী এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরও সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতায় আনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা অবসরে যাওয়ার পর পেনশন বা অবসরকালীন ভাতা পেয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না, তা–ও ভেবে দেখার বিষয়।
পেনশনের আওতায় স্বকর্মে নিয়োজিত পেশাজীবীদের আনার কথা বলা আছে। এসব পেশায় যাঁরা আছেন, তাঁদের আয় দিয়ে দৈনন্দিন জীবন চালানোই যেখানে দুরূহ, সেখানে তাঁরা পেনশন স্কিমে চাঁদা দেবেন কীভাবে? যাঁদের আয়ই নেই, তাঁরা কীভাবে চাঁদা দেবেন? সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উপার্জন করেন না এমন গৃহিণীরাও এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন; তাঁরা পরিবারের অন্য সদস্যদের আয় থেকে চাঁদা জমা দেবেন।
সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য নির্ধারিত সমতা পেনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের মাসিক চাঁদার অর্ধেক দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। দেশের শ্রমিকদের বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, যাঁদের বেশির ভাগেরই নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাঁদের পাশাপাশি বেকারদের এই কর্মসূচির আওতায় আনতে হলে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
সর্বজনীন পেনশন একটি জনবান্ধব কর্মসূচি হলেও এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি জটিল। যেসব উন্নত দেশে এই কর্মসূচি সফল হয়েছে, সেসব দেশের অধিকাংশ মানুষের পেনশন স্কিমে চাঁদা দেওয়ার অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের সেই সামর্থ্য নেই। তারপরও বিষয়টি নিয়ে জনমনে যেসব প্রশ্ন আছে, সেগুলোর উত্তর পাওয়া জরুরি। এই কর্মসূচির আওতায় সব কর্মক্ষম নারী-পুরুষকে নিয়ে আসতে হলে ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।
অর্থনীতিবিদেরা সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিকে স্বাগত জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তাঁরা জনগণের কাছ থেকে আহরিত অর্থ কোন খাতে ব্যয় করা হবে, সে প্রশ্নও রেখেছেন। যদি এটা উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হয়, তাহলে অর্থনীতি গতিশীল হবে। আর অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হলে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়বে।
ইতিমধ্যে এই কর্মসূচির প্রতি জনগণের বেশ আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। উদ্বোধনের পর গত কয়েক দিনে ৪০ হাজারের মতো মানুষের নিবন্ধন এবং ১ হাজারের বেশি ব্যক্তির কিস্তি জমা দেওয়া নিশ্চয়ই আশাব্যঞ্জক ঘটনা। অতীতে অনেক ভালো কর্মসূচিও দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার কারণে সফলতা পায়নি। সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি এগিয়ে নিতে হলে এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে; দূর করতে হবে অসংগতিগুলোও।