তাঁর কীর্তি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবে

সম্পাদকীয়

‘জনবান্ধব চিকিৎসক’ হিসেবে খ্যাত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত শোকাবহ ঘটনা। তিনি ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, গণমুখী ওষুধনীতি ও স্বাস্থ্যনীতির উদ্যোক্তা। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিবেকের কণ্ঠস্বর।

ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতি করা জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭১ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা নিতে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট ত্যাগ করে দেশে চলে আসেন এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী মেলাগড়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল।

স্বাধীনতার পর সেটাই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি যে গণবিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন, সেটাও ব্যতিক্রমী এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন এক বিরল কর্মযোগী ও স্বাপ্নিক মানুষ। স্বাধীনতার আগে তো বটেই, পরেও দেশের ওষুধের বাজার বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৮২ সালে সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে তাঁরই উদ্যোগে জাতীয় ওষুধনীতি প্রণীত হয়, যা দেশকে ওষুধশিল্পে স্বাবলম্বী করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ। একই সঙ্গে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বৈশ্বিকভাবে বিকল্প স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর গণস্বাস্থ্য–ভাবনারই প্রতিফলন ঘটে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। দরিদ্র রোগীদের স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি তিনি তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিডনি রোগীদের জন্য যে ডায়ালাইসিস সেন্টার করেছে, সেখানে প্রতিদিন শত শত গরিব ও দুস্থ রোগী চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন।

ছাত্রজীবনের পর সরাসরি রাজনীতি না করলেও জাফরুল্লাহ চৌধুরী বরাবর রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করেছেন। বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে তিনি সাধ্যমতো ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি পদে এম এ জি ওসমানীকে প্রার্থী করা, ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন কিংবা সম্প্রতি গণতন্ত্র মঞ্চের যাত্রায় তাঁর শরিক হওয়াকে অনেকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও গণতন্ত্র ও জনগণের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী কর্ম ও চিন্তায় নিজেকে এমন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে ‘ব্যক্তিগত’ কিছু ছিল না। সবটাই তিনি উজাড় করে দিয়েছেন দেশ ও জনগণের কল্যাণে। এ কারণে দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা ও সমীহ আদায় করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে বিপুল প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তঁাকে অনন্য হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল স্পষ্টবাদিতা। তিনি যা সত্য মনে করতেন, সেটা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতেন। তিনি কখনো কারও মুখের দিকে তাকিয়ে বলতেন না।

এ কারণে দেখা গেছে, তাঁকে যে রাজনৈতিক দলের লোক হিসেবে অনেকে বিবেচনা করতেন, সেই দলও তাঁর কঠোর সমালোচনা করেছে। অত্যন্ত বেদনার বিষয় হলো, এই মানুষটিকেও আমাদের সংকীর্ণ রাজনীতি অনেক সময় শান্তিতে থাকতে দেয়নি। গণবিশ্ববিদ্যালয়ের জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ক্ষমতাশ্রয়ী স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর বিরুদ্ধে মাছ ও গাছ চুরির মামলা দিয়ে হয়রানি করতেও দ্বিধা করেনি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে একুশ শতকের করোনাভাইরাস মহামারি—এই পুরো পাঁচ দশকেই গণমানুষের সেবায় নিবেদিত ছিলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

শেষ দিকে কয়েক বছর তিনি কিডনিসহ নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস নিতে হতো তাঁকে। এরপরও তিনি যেখানে ডাক পড়ত ছুটে যেতেন কর্তব্যবোধের তাগিদে।

মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা স্বাস্থ্যসেবার জন্য জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন এক আপসহীন যোদ্ধা। তাঁর কীর্তি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

এ জীবনযোদ্ধার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।