উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

সম্পাদকীয়

২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব মানুষ যাতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) দ্বিতীয় দফায় ক্ষুধামুক্তির কথা বলা হয়েছে। ২০১৫ সালে সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার পর ২০১৬ সালে এসডিজি ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ এর অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।

সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রায় চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যু হ্রাস ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নে আমাদের অগ্রগতি ছিল উল্লেখযোগ্য। উন্নয়নশীল অনেক দেশের চেয়ে ভালো।

স্বাভাবিকভাবে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও বাংলাদেশ ভালো করবে—এটাই প্রত্যাশিত। কৃষিসহ অনেক খাতে আমাদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো।

এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা কেবল নেতিবাচক নয়, উদ্বেগজনকও। ‘অ্যাটলাস অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস ২০২৩’ শিরোনামের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে এখন ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য তাঁদের নেই।’

সম্প্রতি এসডিজি অর্জনে ১৭টি লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি কেমন, তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বিবেচনায় আনলে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন না। বাংলাদেশের ওপরে আছে ভারত, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও চীন। এর সব কটি দেশের জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার না পেলে এসডিজির দ্বিতীয় লক্ষ্য ক্ষুধামুক্তি (জিরো হাঙ্গার) অর্জন সম্ভব নয়।

পুষ্টিকর বা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে না পাওয়া মানুষ সব দেশেই কিছু না কিছু আছেন। তাই বলে জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ! সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রতিনিয়ত আমাদের উন্নয়নের যে গল্প শোনাচ্ছেন, এসব তথ্য তার সঙ্গে খাপ খায় না। সরকারি হিসাবেই দেখা যায়, জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

তাঁদের কেউ স্বাস্থ্যসম্মত বা পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারার কথা নয়। সরকারি উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য স্বল্প দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য সরবরাহের জন্য এক কোটি পরিবারকে কার্ড দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমেও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে উল্লেখিত জনগোষ্ঠী যে আয় করেন, তা দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনা সম্ভব নয়।

অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৩ শতাংশ অতিদরিদ্র এবং তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। সুষম পুষ্টিকর খাবারের তালিকায় রয়েছে ভাত, রুটি, সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও তেলজাতীয় খাদ্য। সেগুলো একটি পরিবারকে কিনে খেতে গেলে দিনে ১৭৪ টাকা খরচ হয়। অথচ খাওয়ার পেছনে ওই অর্থ খরচের সামর্থ্য অনেকের নেই।

স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের সমস্যাটি আগেও ছিল। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র তো বটেই, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষেও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনা সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে, সে হারে তাদের আয় বাড়ছে না।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক উন্নতি করলেও চরম বৈষম্যের কারণে এর সুফল পাচ্ছে মুষ্টিমেয় মানুষ। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই আছে। আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় অবশ্যই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।