সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ এবং হল প্রশাসন ও পুলিশ যে আচরণ করেছে, তা সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্তবুদ্ধি চর্চার স্থান ও একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে মতপ্রকাশের পরিসর কতটা সংকুচিত হয়েছে, এ ঘটনা তারই একটি দৃষ্টান্ত।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মেফতাহুল মারুফ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে থাকেন। শিক্ষার্থীদের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে সম্প্রতি ছাত্রলীগের একটি কর্মসূচির ফলে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে, এমন অভিযোগ করে মন্তব্য লেখেন তিনি। ২০০৫ সালে দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদে কর্মসূচিটির আয়োজক ছিল ছাত্রলীগ।
মেফতাহুল লেখেন, ‘সিরিজ বোমা হামলা চালাইছে জামাআতুল মুজাহিদিন নামের একটি জঙ্গি সংগঠন বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে। সেই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত। ক্ষমতায় থাকার জন্য যদি তারা দায়ী হয়, তাহলে ২০০৮-বর্তমানে গুলশানসহ সব জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ।’
মেফতাহুলের এ মতকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে জিয়াউর রহমান হলের ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী তাঁকে ধরে প্রাধ্যক্ষের কাছে নিয়ে যান। প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন সেই মন্তব্যে রীতিমতো রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে তাঁর হলের একজন শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পুলিশি হেফাজতে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে, কিন্তু মামলা করার মতো ‘পর্যাপ্ত উপাদান’ না পাওয়ায় শিক্ষকদের হেফাজতে ছেড়ে দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটি সুপ্রতিষ্ঠিত। সমাজ ও রাষ্ট্রে মুক্তচিন্তার বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সত্য হলো, গত কয়েক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ মুক্তমত চর্চার অন্তরায় এবং ভিন্নমত দমনের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মেফতাহুলকে শুধু পুলিশের কাছে সোপর্দ করেই ঘটনা শেষ হয়নি।
মুক্তির পর শাহবাগ থানা থেকে তাঁকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে ছাত্র অধিকার পরিষদের দুই নেতা হামলার শিকার হন। ভবিষ্যতে মেফতাহুল যে আর কোনো হামলার শিকার হবেন না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? প্রশ্ন হলো, ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে লেখা একটা মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার মতো গুরুতর অভিযোগ কীভাবে তোলা সম্ভব? শিক্ষার্থীকে মধ্যরাতে তাঁর কক্ষ থেকে ধরে নিয়ে আসার অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? প্রাধ্যক্ষ কোন বিবেচনায় শুধু ছাত্রলীগের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে তাঁর হলের একজন শিক্ষার্থীকে পুলিশের কাছে তুলে দিলেন?
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ শিক্ষার্থী ও ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন চলে আসছে। মারধর, মানসিক লাঞ্ছনা, গেস্টরুমে হাজিরা দেওয়া, কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা, হল থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়।
শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও সেটা উপেক্ষা করে আসা হচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত চার দিনের সফর শেষে দেওয়া বিবৃতিতে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো আমলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলেও উদ্বেগ জানান তিনি। শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়, ডিজিটাল মাধ্যমে নজরদারি আরও নানাভাবে চলছে।
নিজের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মানসিক নির্যাতন বলে বর্ণনা করে মেফতাহুল প্রশ্ন করেছেন, এ অন্যায়ের বিচার কে করবে? কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গেই এ ধরনের অন্যায় অগ্রহণযোগ্য। এভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন চলতে পারে না। মেফতাহুলের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও মতপ্রকাশের প্রকৃত কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।