বন্দী–নিখোঁজ তরুণদের ফিরিয়ে আনতে হবে

সম্পাদকীয়

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গল্পটা যে কতটা ফাঁপা আওয়াজ ছিল, সেটা তরুণদের বেকারত্ব, কাজের অনিশ্চয়তার দিকে তাকালেই খোলাসা হয়ে যায়। কর্মসংস্থানহীন সেই প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে নিষ্ঠুর বলি আমাদের তরুণেরা, যাঁদের অনেকেই ভাগ্য ফেরাতে বিদেশে পাড়ি দিতে মরিয়া।

এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে একদিকে হাজারো পরিবারকে নিঃস্ব করেছে দালাল চক্র, অন্যদিকে ভিনদেশে গিয়ে ভাগ্যান্বেষী তরুণদের অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ভাগ্যের জোরে তাঁদের কেউ দেশে ফিরতে পেরেছেন। অথচ মানব পাচার চক্র সবার চোখের সামনে এ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। 

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জের ২৫টি পরিবারের ২৬ যুবককে ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় পাঠায় একটি দালাল চক্র। এ জন্য প্রত্যেককেই ১১ লাখ করে টাকা দিতে হয়েছে। নির্যাতন ও হয়রানির পর তাঁদের মধ্যে ৯ যুবক দেশে ফিরে এলেও বাকিদের কেউ কেউ বন্দী এবং কয়েকজন এখনো নিখোঁজ। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে ২৫টি পরিবার। দালালদের বিচার দাবি করে ক্ষতিপূরণ চেয়ে স্বজনেরা এলাকায় মানববন্ধনও করেছেন।

লিবিয়া থেকে বেঁচে ফেরা কয়েকজন তরুণ তাঁদের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা আমাদের মধ্যযুগের দাসপ্রথার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভুক্তভোগী সুমন মিয়া জানান, ইতালি নেওয়ার কথা বলে তাঁদের লিবিয়া নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। একটি ক্যাম্পে নিয়ে তাঁদের রাখা হয় দেড় মাস। সেখানে প্রতিদিন তাঁদের মারধর করা হতো। ২৪ ঘণ্টার জন্য একবার খাবার দেওয়া হতো। গোসল ও প্রস্রাব-পায়খানার জন্য দুই লিটার লোনা পানি দিত এবং শুধু রাতে একটি রুটি দিত। অনেক সময় খাবার দেওয়া হতো না, পানি চাইলে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হতো।

বলা চলে লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ায় ভাগ্যের জোরে ৯ তরুণ দেশে ফিরতে পারলেও বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেটা জানা যাচ্ছে না। পরিবারগুলো জমানো টাকা ও জমি বিক্রি করে তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়েছিল।

আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটা বড় দায়িত্ব যাঁরা লিবিয়ায় বন্দী ও নিখোঁজ রয়েছেন, তাঁদের সন্ধান বের করে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া। সে জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। দেশি–বিদেশি দালাল চক্রের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তরুণেরা যাতে প্রবাসে যেতে প্রতারণার শিকার না হন, সে জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। শত ঝড়ঝাপটার মধ্যেও বাংলাদেশ যে শক্তভাবে টিকে আছে, তাতে মূল অবদান প্রবাসীদের। তাঁদের যোগ্য সম্মানটুকু দিতে হবে।