ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পরও কি হুঁশ হবে না

সম্পাদকীয়

যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণে দুর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে অনুসারে প্রস্তুতি নিয়ে ও যাবতীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে কাজ চালানোটাই নীতিমালা ও আইনের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কাগজে-কলমে সবকিছুই মানা হয়, লোকবল নিয়োগ ও অর্থ বরাদ্দ সবকিছুই হয়, কিন্তু দিন শেষে তার কিছুই পালন করা হয় না। যার করুণ পরিণতিই আমরা দেখলাম গত সোমবার রাজধানীর উত্তরায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) কাজের সময় কংক্রিটের গার্ডারচাপায় দুই শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায়। বিশেষজ্ঞরা এটিকে মৃত্যু বলতে নারাজ, তাঁদের দৃষ্টিতে এটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড।

এ ঘটনার পরও বিআরটির কাজে আমরা চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা দেখতে পাচ্ছি। এখনো সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় প্রকল্পটির অন্যান্য অংশে কাজ চলছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিআরটি প্রকল্পের রেলিং স্থাপনের কাজ চলছে। জনবহুল মোড়টিতে প্রতিদিন কয়েক হাজার যানবাহন ও মানুষের চলাচল থাকলেও সেখানে কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের শিববাড়ী মোড় পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার সড়কেও একই চিত্র। সেখানেও দুর্ঘটনা এড়াতে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেই, ধারেকাছে বিআরটির কোনো শ্রমিক বা কর্মচারীরও কোনো উপস্থিতি নেই।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিআরটির কাজ শুরু করার আগেই অনেকবার প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তখন তাঁরা নিরাপত্তাব্যবস্থা, ধুলাবালু রোধ, বিকল্প রাস্তা নির্মাণসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন; কিন্তু প্রকল্প কর্মকর্তারা তার কিছুই করেননি। দুর্ঘটনার পর উত্তরা অংশে গতকাল বৃহস্পতিবার কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি জানান, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর কাজ শুরু হবে। কিন্তু উত্তরার সেই অংশে কাজ বন্ধ রাখা হলেও পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, সড়কের মাঝখানে একটার ওপরে আরেকটা স্তূপ করে গার্ডার রাখা। বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। কংক্রিটের স্ল্যাব থেকে লোহার রড বেরিয়ে রয়েছে। প্রকল্প ঘিরে তখনো কোনো ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া হয়নি।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বাংলাদেশ সরকার ও আরও দুটি সংস্থার অর্থায়নে বিআরটি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ঠিকাদারের কাজ নিয়মমতো এবং মানসম্মত হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরামর্শক ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার। কাজ করার সময় যথাযথ সুরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যেমন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার, তেমনি যাদের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে তাদেরও বিষয়টির প্রতি নজরদারি থাকার কথা। এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে চলে আসছে, তাতে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে নিরাপত্তা তদারকির বিষয়টি সব তরফেই উপেক্ষিত হয়েছে। উত্তরার দুর্ঘটনার জন্য তাদেরও দায় নিতে হবে। শুধু ক্রেনচালক, নির্মাণশ্রমিক বা ঠিকাদারকে দায়ী করে এ প্রকল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। নিয়মমতো সব নিরাপত্তা বিধি মেনে চলতে তাদের বাধ্য করতে হবে।

সময় ও ব্যয়ের দিক দিয়ে দেশের অন্যতম দীর্ঘায়িত প্রকল্প হয়ে উঠেছে বিআরটি। এ কাজের জন্য বছরের বছর ধরে মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি কল্পনাতীত। সর্বশেষ বাড়ানো মেয়াদের মধ্যেই এ প্রকল্পের কাজ শেষ করা হোক। প্রকল্পের অধীন গোটা এলাকায় সুরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা তৈরিতে আর কোনো অবহেলা বা দায়িত্বহীনতা নয়। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হোক। উত্তরার মতো আমরা আর কোনো ট্র্যাজেডি দেখতে চাই না।