ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে তাদের তৎপরতা লক্ষণীয়ভাবে কম। গণ–অভ্যুত্থানের দুই মাস পূর্তি উপলক্ষে গত শনিবার আয়োজিত সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের কণ্ঠেও ক্ষোভ লক্ষ করা গেছে। তাঁরা বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষের পেটে লাথি দেওয়া সিন্ডিকেটগুলো এখনো সক্রিয়।’ এটাই তো স্বাভাবিক যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকার যদি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে থাকে বা না নিতে পারে, তারা সক্রিয় থাকবেই।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে প্রায়ই অভিযোগ করা হতো। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীও এ ব্যাপারে সোচ্চার থেকেও কিছু করতে পারেননি। অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের আঁতাত ছিল বলেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পর বাজার পরিস্থিতির পরিবর্তন কেন হচ্ছে না, সেটাই দেখার বিষয়। বাজার সিন্ডিকেট তো অদৃশ্য শক্তি নয় যে তাদের ধরা বা ছোঁয়া যাবে না।
আমরা যখন সিন্ডিকেট নিয়ে কথা বলছি, তখন বাজারের প্রকৃত চেহারাটি কী? টিসিবির বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৮ আগস্টের তুলনায় গত বৃহস্পতিবার মোটা চাল কেজিতে ১ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৬ টাকা, পাম তেল ১২ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১০ টাকা, চিনি ৩ টাকা ও ডিম ডজনে ১৫ টাকা বেড়েছে। বিপরীতে পেঁয়াজ ও আলুর দাম কেজিতে ৫ টাকা কমেছে। এ দুটি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে আমদানির ব্যবস্থা করে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও ডিমের শুল্ক-কর কমিয়েও কর্তৃপক্ষ ভোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, গত সেপ্টেম্বরে প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মজুরি বেড়েছে ৮ শতাংশের মতো। এর অর্থ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমেছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
চালের দাম বাড়লে গরিব মানুষের ওপরই বেশি চাপ পড়ে। কেননা তাঁদের ব্যয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয় চাল কিনতে। এ বছর ধানের বাম্পার ফলন সত্ত্বেও সারা বছরই চালের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সম্প্রতি ভারত চাল রপ্তানি উন্মুক্ত করেছে, সরকার চাইলে সেই সুযোগ নিতে পারে। আমদানি হলে চালকলের মালিকেরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াতে পারবেন না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যথার্থই বলেছেন, ভবিষ্যতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক নানা চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। নিত্যপণ্যের বাজার ও সরবরাহব্যবস্থায় সংস্কার দরকার। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সক্রিয় হতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক বিষয়ে কমিশন ও টাস্কফোর্স গঠন করেছে, কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে তারা সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অন্যদিকে টিসিবির মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানোরও কোনো উদ্যোগ নেই।
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সীমিত আয়ের মানুষ ভীষণ কষ্টে আছেন। তাঁদের ব্যয় অনুপাতে আয় বাড়েনি। তারপরও আছে সিন্ডিকেটের নানা কারসাজি। আমরাও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলতে চাই, যে সিন্ডিকেট সাধারণ মানুষকে দুর্দশার মধ্যে ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর চেষ্টা নিষ্ফল রোদন ছাড়া কিছু নয়।