সোমবার ‘তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৪: বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’ শীর্ষক সম্মেলনে অর্থনীতিবিদেরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় স্বস্তির (মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য) ওপর জোর দিয়েছেন।
দৈনিক বণিক বার্তা আয়োজিত এ সেমিনারে অর্থনীতিবিদ ছাড়াও সরকারের নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বক্তব্য দেন। তাঁদের বক্তব্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য নিরসন, ব্যবসা সহজীকরণ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা উঠে আসে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ভবিষ্যতের অর্থনীতির একটা ফুটপ্রিন্ট রেখে যাওয়ার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতিকৌশল বদলের রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দেশের আর্থিক খাত পাকিস্তানের চেয়েও দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ভিয়েতনাম ১৪ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে, বাংলাদেশ ১ বিলিয়ন ডলারও পায়নি বলে জানিয়েছেন ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। দুটি তথ্যই আমাদের উদ্বিগ্ন করে। এর প্রতিকারে বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক নীতিকৌশলের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য নিয়মকানুন সহজ করা জরুরি বলে মনে করি।
সেমিনারে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আশ্বাস দিয়েছেন, ভবিষ্যতে তাঁরা ক্ষমতায় গেলে জিডিপির ৫ শতাংশ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যয় করা হবে। তাঁর এই আশ্বাসবাণী রক্ষিত হবে বলে আশা করি।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু মূল্যস্ফীতি কমাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, অর্থনীতিকে গলাটিপে ধরলে সমস্যার সমাধান হবে না। দেশের অর্থনীতি ভালো করতে হলে রাজনীতি ভালো করার কোনো বিকল্প নেই।
একজন ব্যবসায়ী ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল সমস্যা আমলাতন্ত্র বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটা উপেক্ষণীয় নয়। পূর্বাপর সরকারগুলো বহু বছর ধরেই বিনিয়োগানুকূল পরিবেশ তৈরি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার কথা বললেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। ভিয়েতনামে সাত দিনে নতুন একটি কোম্পানি ব্যবসা শুরু করতে পারলেও আমাদের এখানে সাত মাস লাগার কোনো যুক্তি নেই।
গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে সুনামি বয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান। কিন্তু এই সুনামি রোধে ব্যবসায়ী বা ব্যাংকারদের পক্ষ থেকেও যে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, সেটাও তাঁদের স্বীকার করতে হবে। বরং একশ্রেণির ব্যবসায়ী ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গায়েব করে দিয়েছেন। অতএব, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও গতি ফিরিয়ে আনতে হলে খেলাপি ঋণ আদায়ের বিকল্প নেই।
স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নরের সময়োচিত সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। ডলারের দরে স্থিতিশীলতা ফিরছে। কিন্তু অর্থনীতির অন্য খাতগুলো ভঙ্গুরই রয়ে গেছে।
সেমিনারে সরকারের নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদেরা যেসব মন্তব্য করেছেন, তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেও বলতে চাই, এই মুহূর্তে জনজীবনের মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে না পারলে অর্থনীতির কোনো সংস্কার উদ্যোগই টেকসই হবে না। আগে বাজার ঠিক করুন, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করুন।
সবশেষে বলব, অর্থনীতির গতি ফেরাতে নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।