সরকারের কথা ও কাজে মিল কতটা?

সম্পাদকীয়

বাল্যবিবাহকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করে সরকার এর নিরোধে আইন করেছে, শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে। কিন্তু ইউএনএফপিএর বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩ প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হয়। এতে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে; যা এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে।

‘৮০০ কোটি জীবন, অপরিসীম সম্ভাবনা’ (এইট বিলিয়ন লাইভস, ইনফিনিট পসিবিলিটিজ) শিরোনামে বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩ বৈশ্বিকভাবে প্রকাশিত হয় গত ১৯ এপ্রিল। বাংলাদেশে রোববার রাজধানীর গুলশানে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) স্যাটেলাইট কার্যালয়ে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেন বাংলাদেশে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্রিশ্চিন ব্লুখস। প্রতিবেদনে ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম বাল্যবিবাহ ঘটছে মালদ্বীপে—মাত্র ২ শতাংশ। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় ১০, পাকিস্তানে ১৮, ভারতে ২৩, ভুটানে ২৬, আফগানিস্তানে ২৮ ও নেপালে ৩৩ শতাংশ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয় নাইজারে—৭৬ শতাংশ।

বাল্যবিবাহের সঙ্গে মাতৃমৃত্যুর নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে হলে প্রজননস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি উন্নয়নে আশানুরূপ অগ্রগতির কারণে শুধু দারিদ্র্য নয়, সামাজিক আচার-আচরণও। বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার জন্য সরকারের নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তারা করোনার অজুহাত দিচ্ছেন। করোনা মহামারির সময় দেশে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছিল, তা বিভিন্ন জরিপেও এসেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাল্যবিবাহের ওপর ইউএনএফপিএর এক জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছিল।

ওই সময় গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহল থেকে এর বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হলেও নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেননি। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও অস্পষ্ট। একদিকে তাঁরা ২০১৭ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে শাস্তি বাড়িয়েছেন, অন্যদিকে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের সুযোগও রেখে দিয়েছেন।

সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ নির্মূল এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ এক-তৃতীয়াংশ কমানোর যে লক্ষ্য ছিল, তা থেকে সরকার অনেক পেছনে আছে। মাতৃমৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে—এটা প্রমাণ করে না যে বাল্যবিবাহ কমেছে। বিবিএসের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২১ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে এক লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন ১৬৮ জন মা। মাতৃমৃত্যুর ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। সবচেয়ে বেশি মাতৃমৃত্যু আফগানিস্তানে। সবচেয়ে কম মৃত্যু শ্রীলঙ্কায়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, সরকারের নীতিনির্ধারকেরাই বলেন তাঁদের কথা ও কাজে কতটা মিল আছে? মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে পারলেও আমরা বাল্যবিবাহ কেন কমাতে পারলাম না?

বাল্যবিবাহ নামের ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে আইনের বিশেষ বিধান বাদ দিতে হবে। করোনার আগে আইনের প্রয়োগের বিষয়ে সরকার যেভাবে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল, সেটা জারি রাখতে হবে। যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে অভিভাবকেরা মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেন, সেই কারণগুলোও দূর করতে হবে। এখনো অনেকে জন্মসনদ বদলে বাল্যবয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে থাকেন। এটা যাতে না পারেন, সে জন্য অনলাইনে সবার জন্মসনদ পাওয়া নিশ্চিত করা হোক।

এ বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক জাগরণ প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ রদ না করে স্মার্ট বাংলাদেশ করার চিন্তা আকাশকুসুম কল্পনাই বটে।