ব্যাখ্যা হাস্যকর, নিরপেক্ষ তদন্ত হোক

সম্পাদকীয়

যখন সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে সব পর্যায়ে নিয়োগ দেওয়ার দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা রাজপথে আন্দোলন করছেন, তখনই বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা জনগণের সামনে এল। পিএসসির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নপত্র দিনের পর দিন ফাঁস হওয়ার যে তথ্য বের হয়েছে, তাতে আমরা স্তম্ভিত।

একটি বেসরকারি টেলিভিশন ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম বেরিয়ে আসে। এরপর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সিআইডি ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে, যাঁদের মধ্যে পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির, কর্মচারী (ডেসপাস রাইডার) মো. খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমানও আছেন।

এই চক্রের সঙ্গে সাবেক সেনাসদস্য থেকে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীর নামও এসেছে। এতে প্রমাণিত হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের জাল বহুদূর বিস্তৃত।

সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে পিএসসির কর্মী সাজেদুল ইসলাম জানান, রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নটি দুই কোটি টাকার বিনিময়ে উপপরিচালক মো. আবু জাফরের কাছ থেকে নিয়েছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, এর আগেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষের ট্রাংক খুলে তিনি প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে ফাঁস করেছেন। সেগুলোর মধ্যে বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও রয়েছে।

পিএসসি রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যাদের মাধ্যমে প্রতিবছর বিভিন্ন সরকারি পদে হাজার হাজার তরুণ নিয়োগ পেয়ে থাকেন। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নপত্রই যদি ফাঁস হয়ে যায় এবং সেখানকার কর্মকর্তারাই যদি এতে জড়িত থাকেন, তবে মানুষ আর কিসের ওপর ভরসা রাখবে?

যেখানে একটি পদের বিপরীতে শতাধিক কিংবা তারও বেশি প্রার্থী থাকেন, সেখানে কী রকম কঠিন প্রতিযোগিতা করে একজনকে চাকরি পেতে হয়, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। কিন্তু সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই যদি এভাবে ফাঁস হয়, তাহলে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসির চরম অক্ষমতা ও দুর্বলতাকেই তুলে ধরছে।

পিএসসির কাজ হচ্ছে যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য ও মেধাবীদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য নির্বাচিত করা; যারা দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করবেন। এখন দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার মানে শুধু রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগের পরীক্ষাই নয়, এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে অতীতে অনেকেই নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁরা এখন সরকারের বিভিন্ন পদে কাজ করছেন। ফলে অনেক যোগ্য প্রার্থী ও চাকরিপ্রার্থী যেমন বঞ্চিত হয়েছেন, তেমনি নিয়োগ পেয়েছেন অযোগ্যরা। এই চরম দায়িত্বহীনতার দায় প্রতিষ্ঠানটি এড়াবে কীভাবে?

প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে পিএসসি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, সেটি হাস্যকর। একদিকে তারা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছে, অন্যদিকে বলেছে, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে থাকে, তাহলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্ন আসে কেন?

সর্বশেষ খবর হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসসি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। যেখানে পিএসসির কর্মকর্তারা অভিযুক্ত, সেখানে তাঁদের দ্বারা গঠিত কমিটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা মনে করি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত সব ব্যক্তি ও তাঁদের নেপথ্যের কুশীলবকে খুঁজে বের করতে হলে পিএসসির বাইরের লোকদের নিয়েই নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।