বাংলাদেশে যখন যে সরকার আসে, তাদের মতো পাঠ্যবই সাজায়। ফলে সেখানে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণ ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার প্রয়াস থাকে, যার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। পাঠ্যবইয়ের শেষ প্রচ্ছদে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও উদ্ধৃতি থাকা এ রকমই একটি উদাহরণমাত্র।
শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও উদ্ধৃতির স্থলে পাঠ্যবইয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি বা দেয়ালে আঁকা ছবি থাকবে। অভ্যুত্থানের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া অন্যায় নয়। পাঠের বিষয় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু তার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো। বছরের ১০ মাস চলে গেছে, বাকি আছে মাত্র দুই মাস।
একজন মুদ্রণকারী প্রথম আলোকে বলেছেন, এবার বছরের শুরুতে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দেওয়ার বিষয়ে তিনি আশা দেখছেন না। অবশ্য এনসিটিবির কর্মকর্তারা আশা করছেন, পরিমার্জনের কাজ পুরোপুরি শেষ করে এ মাসের মধ্যেই মুদ্রণকারীদের হাতে পাণ্ডুলিপির সিডি দিতে পারবেন।
বর্তমানে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছর চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেণিতেই তা চালুর কথা ছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে নতুন শিক্ষাক্রম কার্যত বাতিল হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরোনো শিক্ষাক্রমের বই হলেও বিষয়বস্তুতে কিছু পরিবর্তন হবে। পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে ইতিমধ্যে পাঠ্যবই আছে। প্রসঙ্গত, শিক্ষাক্রম ২০১২ সালের হলেও সর্বশেষ ২০২২ সাল পর্যন্ত এই শিক্ষাক্রমের আলোকে বই দেওয়া হয়েছে। সেগুলোই এখন পরিমার্জন করে ছাপার উপযোগী করা হচ্ছে। এর আগে পাঠ্যবই পরিমার্জন কাজ তদারকির জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল সরকার। পরবর্তীকালে মহলবিশেষের আপত্তির মুখে সেই কমিটি বাতিল করা হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পরিমার্জনের মাধ্যমে বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতিফলন থাকছে। তবে যেহেতু এই অভ্যুত্থানের বিষয়টি অতি নিকট ইতিহাস এবং এবার সময়ও কম, তাই লেখা হিসেবে না রেখে কিছু পাঠ্যবইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি বা দেয়ালে আঁকা ছবি ইত্যাদি বিষয় রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
চলতি বছর সরকার একটি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পাঠ্যবই ছাপার পুরো কাজটি তারা দেশি মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই করবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা যেমন বাঁচবে, তেমনি দেশ মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবেও লাভবান হবে। এই সুযোগে কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে নিম্নমানের ছাপা বই গছিয়ে দিতে না পারে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সজাগ থাকতে হবে।
এবার বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য বছরও দেখা যায়, কর্তৃপক্ষ পাঠ্যবইয়ে ছাপার কার্যাদেশ দিতে অহেতুক দেরি করে। ফলে মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানগুলো তাড়াহুড়া করে যে বই ছাপে, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। এ ছাড়া পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে বই ছাপার কাজ করানো হয়। এবার তার পুনরাবৃত্তি হবে না, এটাই প্রত্যাশিত। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় কার্যাদেশ পেলে মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাপা ও কাগজের মানোন্নয়নের বিষয়ে অধিক যত্নশীল হবে আশা করা যায়।