আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী তাদের এদেশীয় সহযোগীদের সহায়তায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। এর আগে মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধের সূচনামুহূর্তেও ঘাতক বাহিনী অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল। শুধু মার্চ ও ডিসেম্বর নয়, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতে বাঙালি কবি, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো—এ ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার দুরভিসন্ধি এঁটেছিলেন পাকিস্তানি শাসকেরা।
১৯৭১ সালে আমাদের বিজয়ের আগমুহূর্তে যখন দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে যে তাদের পরাজয় অনিবার্য, তখন তারা তালিকা করে জাতির বরেণ্য সন্তানদের হত্যার জন্য ঘাতক বাহিনী আলবদর-আলশামসকে লেলিয়ে দেয়। পরাজয়ের আগমুহূর্তে তারা চূড়ান্ত আঘাত হানে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার অভিপ্রায়ে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত যেসব বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে আমরা হারিয়েছি, তাঁদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, আবুল খায়ের, আনোয়ার পাশা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন প্রমুখ।
পাকিস্তানি দুঃশাসনের দিনগুলোতে আমাদের লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন। এসব কারণেই তাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের জিঘাংসার শিকার হয়েছেন। এত কম সময়ে এত বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যার উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া আর নেই।
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্যতম দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীর বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু অস্বস্তির বিষয় হলো আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তিপ্রাপ্ত বিদেশে পলাতক আলবদর কমান্ডার চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের শাস্তি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তাঁরা বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম মূল হোতা ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২-এর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান তাঁর রায়ের পর্যবেক্ষণে এই দুই ঘাতকের নির্মমতার যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তা এককথায় রোমহর্ষ। আশরাফুজ্জামান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ও চৌধুরী মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। যেসব রাষ্ট্র নিজেদের মানবতা ও ন্যায়বিচারের রক্ষক বলে দাবি করে, তারা কীভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ঘাতকদের আশ্রয় দেয়? শুধু আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়, বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল হোতাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন।
আজকের এই দিনে আমরা জাতির এই মহান সন্তানদের শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করি। কিন্তু যাঁরা নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, তাঁদের বছরের একটি দিন স্মরণ করাই যথেষ্ট নয়। আমাদের অনুধাবন করতে হবে, কেন এই মহৎপ্রাণ মানুষগুলো জীবন দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতি গঠনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। অথচ যেকোনো ক্রান্তিকালে মানুষ তাঁদের কাছ থেকে সত্য, ন্যায়ের পথের দিশা পাওয়ার প্রত্যাশা করে। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আজ যে দিবস পালিত হচ্ছে, তা সার্থক হবে, যদি আমরা তাঁদের উদার মানবিক চিন্তা ও গণতান্ত্রিক আদর্শকে ধারণ করতে পারি। তাঁরা যে উন্নত ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই পথ ধরেই বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় জীবনে সংকট কিংবা স্থিতিশীলতার কালে তাঁদের আদর্শ হোক আমাদের পাথেয়।