প্রভাবশালীদের স্বার্থে জনস্বার্থ কেন জিম্মি হবে

সম্পাদকীয়

বর্তমান সরকারের একেবারে শেষ সময়ে এসে প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের নিজ নিজ এলাকায় তোড়জোড় করে প্রকল্প পাস করিয়ে নেওয়ার যে আয়োজন চলছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় একসঙ্গে ৫০টি প্রকল্প উঠছে। এক একনেক সভায় এত প্রকল্প ওঠার নজির নেই। এ ছাড়া আরও ৪০টির বেশি প্রকল্প চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সরকারের হাতে বরাদ্দ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ যখন নেই, তখন প্রকল্প পাসের এই হিড়িকের পেছনে ভোটের বাজারে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া আর কী থাকতে পারে?

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, আজকের একনেক সভাটি হতে পারে বর্তমান সরকারের সর্বশেষ বৈঠক। এ কারণেই এই বৈঠককে প্রভাবশালীরা তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় প্রকল্প পাস করিয়ে নেওয়ার শেষ সুযোগ হিসেবে দেখছেন।

এর আগেও দেখা গেছে, সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে এসে মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের চাপে নানা ধরনের প্রকল্প পাস হয়েছে। এর মধ্যে রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণের মতো প্রকল্পই বেশি থাকে। সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁরা ভোটের আগে জনতুষ্টির এসব প্রকল্প পাস করিয়ে নেন। এবারও এর ব্যতিক্রম দেখা গেল না।

আজকের একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য ওঠা প্রকল্পের মধ্যে বর্তমান সরকারের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের নিজের এলাকার জন্য সেতু নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে। ৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চাঁদপুরের মেঘনা-ধনাগোদা নদীর ওপর একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মিত হবে। এ সেতু নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে নিজ এলাকাতেই প্রশ্ন রয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের গ্রামের বাড়ি মুলাদীতে আড়িয়াল খাঁ সেতুর ওপর ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেড় কিলোমিটার সেতু নির্মাণের প্রকল্পও রয়েছে। সাধারণত প্রকল্পের মেয়াদ একনেকে পাস করার আগে থেকে শুরু হয়। তবে এই প্রকল্প পাস হয়ে থাকবে, পরে কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া সারা দেশের সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী এলাকায় পছন্দমতো রাস্তাঘাট নির্মাণের প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়ানোর প্রস্তাবও উপস্থাপিত হতে পারে বৈঠকে। এর পাশাপাশি বেশ কিছু রাস্তাঘাট নির্মাণের প্রকল্পও উঠছে।

সাবেক সচিব ও বড় অবকাঠামোবিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যথার্থই বলেছেন, সামনে নির্বাচন। ভোটের বাজারে বাড়তি সুবিধা পেতে নিজ নিজ এলাকায় প্রকল্প পাস করানোর চেষ্টা করছেন মন্ত্রী-এমপিরা।

অর্থনৈতিক সংকটে যখন কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলা হচ্ছে, বেছে বেছে প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোতেই বরাদ্দ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, সে সময় প্রভাবশালীদের কেন উপহার হিসেবে প্রকল্প দেওয়া হচ্ছে? সময়মতো প্রকল্প শুরু করা যাবে না, তা জানার পরও প্রভাবশালীরা তাঁদের পছন্দের প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত করে রাখছে। সরকারি অর্থ গুটি কয়েকের স্বার্থে ব্যবহার নৈতিকভাবে কতটা সিদ্ধ?

বাংলাদেশে প্রকল্প পাসের পর নির্ধারিত সময়ে সেটা বাস্তবায়নের নজির নেই বললেই চলে। প্রকল্পের সময় যত বাড়ে, বাজেট তত বাড়ে। আবার অতিপ্রয়োজনীয় প্রকল্প রেখে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প করে ফেলে রাখার নজিরও ভূরি ভূরি। জনগণের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে জবাবদিহি, অঙ্গীকার ও স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন, তার অভাবেই এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে জনস্বার্থ জিম্মি হয়ে পড়ায় এই সংকট। এ থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিকল্প কী?

আমরা মনে করি, সরকারের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে একনেক সভায় একসঙ্গে এতগুলো জনতুষ্টির প্রকল্প অনুমোদন করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থ নয়, প্রকৃত জনস্বার্থে প্রকল্প নেওয়া হোক।