দুর্নীতির লাগাম টানুন, লুণ্ঠিত ঋণ উদ্ধার করুন

সম্পাদকীয়

প্রথম আলো আয়োজিত ‘অর্থনীতি: নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাদের কণ্ঠে অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জগুলো উঠে এসেছে। বক্তারা সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা, নিত্যপণ্যের দাম কমানো, ঋণের নামে ব্যাংক খাতে লুণ্ঠন বন্ধ করা এবং বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন।

গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা নিজ নিজ অবস্থান ও দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে উত্তরণের বাস্তবানুগ সুপারিশ করেছেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম যখন দুই বছরের জন্য মেগা প্রকল্পগুলো বন্ধ রাখতে বলেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বর্তমানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কতটা নাজুক।

নতুন সরকারের সামনে প্রধান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা। মূল্যস্ফীতি বর্তমানে সাড়ে ৯ শতাংশের কাছাকাছি, খাদ্যপণ্যে এটি আরও বেশি। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত কয়েক দিনে চালসহ বেশ কয়েকটি খাদ্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যাওয়ায় জনগণের মধ্যে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। চালের দাম বাড়ার পেছনে কোনো কারসাজি আছে কি না, তা তদন্তপূর্বক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা দুর্নীতি, অর্থ পাচার, বিনিয়োগে স্থবিরতা, ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তা নতুন নয়। বহু বছর ধরেই এই সমস্যা চলে আসছিল। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এসব বিষয় আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন এমনটি বলা যাবে না। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা নিয়ে সরকারের মধ্যে একধরনের আত্মপ্রসাদ লাভের প্রবণতা আছে।

কিন্তু এসব প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় এবং কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে যে উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই বিষয়গুলোর যেমন জবাবদিহি প্রয়োজন, তেমনি ভবিষ্যতে কোনো প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রেও তা বিবেচনায় রাখা উচিত। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের বেশির ভাগই করা হয়েছে বিদেশি ঋণে। অন্যদিকে বৈশ্বিক সংকটের কারণে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির লাগাম টানতে হয়েছে। বড় প্রকল্প বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে না—বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি দেশবাসীও এই নিশ্চয়তা চায়।

নতুন অর্থমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন তিনি। অর্থনৈতিক নীতি–পরিকল্পনায় যেসব কঠোর অথচ অনিবার্য পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেগুলো নিলে সময় দিতে কেউ আপত্তি করবেন না।

 কিন্তু সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে আমরা মিল দেখতে চাই। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি ও ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে বছরের পর বছর আলোচনা হয়। কিন্তু টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চুপ থাকে, কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চুপ করে রাখা হয়। ইসলামি ধারার যে ব্যাংকগুলো এত বছর ভালোভাবে চলছিল, কেন সেগুলোকে ‘কোরামিন’ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে, সেই প্রশ্নেরও উত্তর জানা দরকার।

ব্যবসায়ীরাই বলছেন ৯–৬ সুদের হার নির্ধারণ করা মারাত্মক ভুল ছিল। এখন সুদের হার বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। সর্বোপরি ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ সবার জন্য সমান হতে হবে। মুখ দেখে দই দেওয়ার রীতি বদলাতে হবে।

প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে যেসব সুপারিশ এসেছে, সেগুলো আমলে নিয়ে সরকার যদি কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেয়, তাহলে অর্থনীতিকে গতিশীল করা কঠিন নয়। সবার আগে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরুন, লুণ্ঠিত ঋণ উদ্ধার করে লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন।