ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন হয়ে আসছে নির্দলীয় ভিত্তিতে; যদিও ক্ষমতাসীনেরা সব সময়ই এসব সংস্থা ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালের নভেম্বরে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন-সংক্রান্ত পাঁচটি আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল ও স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞদের বিরোধিতাও তারা আমলে নেয়নি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক বরাদ্দের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও উৎসাহিত করেছে। এতে নির্বাচন কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে, সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও তৃণমূলে দলীয় শৃঙ্খলা যে অনেকটা ভেঙে পড়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রায় সব কটি সংঘাত হয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। নির্বাচনের জেরে এখনো অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগেরর কর্মী–সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এ অবস্থায় আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এবার আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক না দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে বলে শনিবার প্রথম আলোয় খবর বের হয়েছে। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এলাকায় যাচ্ছেন দলীয় বিরোধ মেটাতে। ক্ষমতাসীন দলের কর্মকাণ্ড দেখলে সেই পুরোনো বাংলা প্রবাদই মনে পড়ে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’
এখানে এ কথা বলা প্রয়োজন যে আমাদের সংবিধানে স্থানীয় স্বশাসনের কথা বলা হলেও কোনো সরকারই স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়নি। তারপরও আওয়ামী লীগ আমলে বড় বড় সিটি করপোরেশনে বিএনপির সমর্থক মেয়র এবং বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগের সমর্থক মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন এবং দায়িত্বও পালন করেছেন।
২০১৫ সালে আইনটি সংশোধন করার পরই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ আইনের অপব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো প্রভাবশালী নেতা নিজেদের এলাকায় নির্বাচনটিই প্রহসনে পরিণত করেছেন। তাঁদের হস্তক্ষেপে অনেক স্থানীয় সরকার সংস্থায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জিতে গেছেন। অন্যদিকে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার পর বিরোধী দলও বেশির ভাগ স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে স্থানীয় জনগণের আকাঙ্ক্ষার চেয়ে দলীয় রাজনীতিই প্রাধান্য পেয়েছে।
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন চালু হওয়ার পর কেবল সংঘাত-প্রাণহানিই বাড়েনি; সামাজিক সম্পর্কগুলো ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আগে স্থানীয় নির্বাচনের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ঝগড়া-বিবাদ ভুলে জনগণের সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করতেন। এখন জয়ী কিংবা বিজিত উভয় প্রার্থীর কাছে জাতীয় রাজনীতিই অগ্রাধিকার পায়, উপেক্ষিত থাকে স্থানীয় সমস্যা।
বর্তমানে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চলছে সংকর পদ্ধতিতে; আধা দলীয়, আধা অদলীয়। উপজেলা পরিষদ ও ইউপি চেয়ারম্যান পদে এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কাউন্সিলর ও সদস্যপদে দলীয় প্রতীক দেওয়া হয় না। একই সংস্থার নির্বাচন দুই পদ্ধতিতে হতে পারে না।
এমনিতেই আমাদের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো অত্যন্ত দুর্বল। নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই। আর দলীয় তকমা দেওয়ার পর এর চরিত্রটাই বদলে গেছে।
আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক দেবে কি না, সেটি তাদের বিষয়। আমরা মনে করি, স্থানীয় সরকারের সব সংস্থার নির্বাচন পুরোপুরি নির্দলীয় পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনে সরকার এ রকম কোনো উদ্যোগ নিলে দল-মতনির্বিশেষে সবাই সমর্থন জানাবে আশা করা যায়।