গত সপ্তাহে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি ঢাকার যানজট নিরসন ও যাত্রীদের আরামদায়ক পরিবহনসেবা দিতে আবার ঢাকা নগর পরিবহন চালুর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা অনেকটা আগের সরকারের আমলে নেওয়া সমন্বিত পরিবহনব্যবস্থারই পরিবর্তিত রূপ।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) সূত্রে জানানো হয়, রাজধানী ঢাকায় যাত্রীবাহী সব বাস চলবে ‘ঢাকা নগর পরিবহনের’ আওতায়। তবে বাসগুলোর মালিকানা থাকবে কোম্পানিগুলোর কাছে। নগর পরিবহনের আওতায় বাস পরিচালনার জন্য কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আবেদনপত্র নেওয়া হবে।
সমস্যা হলো, আমাদের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে যোজন ফারাক থাকে। ছয় মাস আগে নেওয়া পরিকল্পনাটি যখন বাস্তবায়ন করা হয়, তখন সমস্যা আরও প্রকট রূপ নেয়। নগর পরিবহন চালুর পরিকল্পনা কত দিনে চালু হবে, বেসরকারি বাসমালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি মেনে চলবে কি না, তার ওপরই নির্ভর করছে এর সাফল্য–ব্যর্থতা। বিগত সরকারের আমলে সমন্বিত বাস চালুর উদ্যোগ নিয়েও সফল করা যায়নি বাসমালিকদের অসহযোগিতার কারণে।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘নগর পরিবহনের অধীনে বাস চালানোর জন্য বাস কোম্পানিগুলোর কাছে আবেদনপত্র চাওয়া হয়েছিল। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০টি বাস কোম্পানি আবেদন করেছে।’ ধারণা করি, ৩০ নভেম্বর শেষ তারিখের মধ্যে বাসমালিকদের কাছ থেকে আরও আবেদনপত্র আসবে। এগুলো যাচাই–বাছাইয়ের কাজটি সহজ নয়। গেল সরকারের আমলে যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিজস্ব লোকের বিষয়টি অগ্রাধিকার পেত। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
চালক ও সহযোগীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বন্ধে বাসভাড়া পরিশোধের জন্য র্যাপিড পাস কিংবা অনলাইনে পরিশোধের পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্তটি ভালো। প্রশ্ন হলো, বাসমালিকেরা সেটা মানবেন কি না, মানলেও কত দিন বাস্তবায়ন করতে পারবেন? কর্তৃপক্ষকে এ কথাও মনে রাখতে হবে, ঢাকা শহরে যানজট যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে সমন্বিত নগর পরিবহনই একমাত্র সমাধান নয়। বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। মেট্রোরেল সম্প্রসারণ কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।
ঢাকা শহরের সড়কের পরিমাণ তুলনামূলক কম। একটি মেগা সিটিতে শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়। ঢাকায় আছে মাত্র ৮ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে যানবাহন চলাচলে শুধু শৃঙ্খলা এনে নগরবাসীর চলাচল নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করা যাবে না। বিকল্প ও সৃজনশীল পথেই অগ্রসর হতে হবে। যানজট নিরসনে অবিলম্বে প্রাইভেট কারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, চৌরাস্তাগুলোয় টানেল নির্মাণ, ছোট ছোট বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা ও ট্রাফিক পুলিশের জনবল বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা শহরে ক্রমবর্ধমান জনস্রোত কীভাবে ঠেকানো যায়, সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সব কাজে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে কেন ঢাকা শহরে আসতে হচ্ছে? নিজ নিজ শহর, জেলা ও উপজেলা থেকে যাতে তাঁরা রাষ্ট্রীয় সেবা পান, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
রাজধানীর যানজট নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১১ দফা প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা যানজট নিরসন কমিটি, যার মধ্যে আছে ঢাকার ভেতরের ও চারপাশের খালগুলো সংস্কার করে নৌপথ সচল করা, চারপাশের নদী ঘেঁষে ট্রাম রোড বা সংক্ষিপ্ত রেলপথ তৈরি এবং ওই রেলপথ ঘেঁষে চক্রাকার সড়ক নির্মাণ। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে অনেক সময় ও অর্থের প্রয়োজন হবে।
এই মুহূর্তে ঢাকায় নগর পরিবহন চালু করতে পারলে সড়কে যানবাহন চলাচলে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তা যেমন কমবে, তেমনি যানজটে নাকাল নগরবাসী কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে পাবেন।