বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে ব্যবস্থা নিন

সম্পাদকীয়

চট্টগ্রামে পুলিশি হেফাজতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক এস এম শহীদুল্লাহর মৃত্যুর ঘটনাটি মর্মান্তিক। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নগরের চান্দগাঁও থানায় এ ঘটনা ঘটে।

৬৭ বছর বয়সী একজন মানুষকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেল, কয়েক ঘণ্টা না যেতেই তাঁর মৃত্যু হলো—এটা মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। এস এম শহীদুল্লাহর ছেলে নাফিজ শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাদাপোশাকে চান্দগাঁও থানার দুই এএসআই (সহকারী উপপরিদর্শক) তাঁর বাবাকে বাসা থেকে থানায় নিয়ে যান। পরে তাঁরা জানতে পারেন, মারামারির একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় তাঁর বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মারামারির ঘটনায় কেউ আসামি হলেই তাঁকে ধরে নিয়ে যেতে হবে কেন?

পরিবারের অভিযোগ, হৃদ্‌রোগী শহীদুল্লাহকে থানা কর্তৃপক্ষ ওষুধ দিতে দেয়নি। চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাইরুল ইসলাম অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর বয়স্ক লোক হওয়ায় দুদকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রথমে আমার কক্ষে আনা হয়।

তিনি হঠাৎ সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে পরিবারের লোকজন গিয়ে তাঁকে ওষুধ দেন। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে পুলিশ ও পরিবারের লোকজন দ্রুত তাঁকে পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।’

একজন হৃদ্‌রোগীর প্রতি কী ধরনের আচরণ করা উচিত, সেটা পুলিশ সদস্যদের জানা থাকার কথা। পুলিশ যদি সত্যিই ওষুধ দিতে বাধা দিয়ে থাকে বা ওষুধ দিতে বিলম্ব করে থাকে, সেটা কেবল অমানবিক নয়, বেআইনিও। এ ঘটনায় দুই এএসআইকে প্রত্যাহার এবং একটি তদন্ত কমিটি করেছে পুলিশ।

আরেক ঘটনায় র‍্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ আছেন রহমত উল্লাহ নামের এক তরুণ। প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৯ আগস্ট জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ধামরাইয়ের গ্রামের বাড়ি থেকে তাঁকে র‍্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। ৩৬ দিন পেরোলেও তাঁর কোনো খোঁজ পাননি স্বজনেরা। রহমত উল্লাহর মা র‍্যাব সদর দপ্তরে গেলে তাঁকে জিডি নিয়ে আসতে বলে, অথচ সংশ্লিষ্ট থানায় তাঁর জিডি নেওয়া হয়নি।

র‍্যাব-৪ সিপিসি-৩ মানিকগঞ্জ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ওই বাড়িতে তাঁদের কোনো টিম যায়নি। তাহলে কারা তাঁকে র‍্যাবের পরিচয়ে তুলে নিল?

সারা দেশে এ ধরনের ঘটনা হরদম ঘটলেও খুব কম ক্ষেত্রেই প্রতিকার পাওয়া যায়। যাঁরা ভাগ্যক্রমে ফিরে আসেন, তাঁরাও কিছু বলেন না। এই না বলার পেছনে একটা ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করে। বছর দুই আগে র‍্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর বিচারবহির্ভূত হত্যা কিছুটা কমে এলেও গুম ও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা খুব একটা কমেনি। র‍্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর মাস তিনেকের মাথায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে মৃত্যু হয় টঙ্গীর বাসিন্দা আলাল উদ্দিনের।

নিরাপত্তা হেফাজতে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও আচরণের বিষয়ে আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ এসব নির্দেশনা মেনে চলে না। আমরা নিরাপত্তা হেফাজতে আর একটিও মৃত্যু দেখতে চাই না। চট্টগ্রামের শহীদুল্লাহসহ পুলিশ ও র‍্যাব হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার যথাযথ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত জরুরি। যাঁরা আইনের প্রয়োগ করেন, তাঁরা যদি এভাবে আইনের অপপ্রয়োগ করতে থাকেন, তাহলে দেশে আইনের শাসন বলতে কিছু থাকবে না।