শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করুন

সম্পাদকীয়

আজ মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকেরা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার কর্মদিবসের বিপরীতে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন।

সেই আত্মদানের পথ ধরেই পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষ ন্যায্য মজুরি, অবকাশ, মানবিক আচরণ, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। অনেক দেশেই শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবি পূরণ হয়েছে, কর্মপরিবেশেরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে; কিন্তু তাঁদের পেশাগত জীবনে নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকার এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি।

এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য মালিকের পুঁজিই যথেষ্ট নয়, শ্রমিকের শ্রমও জরুরি। আজ যখন মে দিবস পালিত হচ্ছে, তখন সরকারি শিল্পকারখানা, তৈরি পোশাকশিল্পসহ কয়েকটি খাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হলেও বিরাট অংশ এর বাইরে থেকে গেছে।

বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি; যঁাদের ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা নেই, নেই চাকরির নিশ্চয়তা। তৈরি পোশাকশিল্পে সর্বশেষ মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালে, ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা ধরে। গত পাঁচ বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও মজুরি বাড়েনি। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ন্যূনতম মজুরি ২২ হাজার টাকা করার দাবি করা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে শ্রমিকেরা যে ন্যূনতম মজুরি পেয়ে থাকেন, তা মানবিক জীবন যাপন করে শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের জন্য খুবই অপ্রতুল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে অর্ধেক আয় করেন দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা।

২০২২ সালের এপ্রিল-জুন তিন মাসে তাঁরা গড়ে মাসিক ৯ হাজার ৯৮৪ টাকা আয় করেছেন। এ সময় তাঁদের ‘লিভিং ওয়েজ’ বা মোটামুটি মানসম্মত জীবনযাপনের জন্য যে আয় দরকার, তা বসবাসের এলাকাভেদে ছিল ১৯ থেকে ২৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ, প্রকৃত আয় ও ন্যূনতম চাহিদা পূরণে দরকারি অর্থ চাহিদার মধ্যে পার্থক্য ৫১ থেকে ৬০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রকৃত ন্যূনতম মজুরি এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে কমেছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ন্যূনতম মজুরি সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। শুধু তা-ই নয়, এ অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচের স্তরের চেয়েও কম। বিশ্বের ১৩৬টি দেশের মজুরি হারের পরিবর্তনের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

দেশের অর্থনীতির সুষম বিকাশের জন্য অবিলম্বে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাপনের ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানবিক জীবনযাপনের জন্য সব খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ সময়ের দাবি। যেসব দেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে, সেসব দেশে শ্রমিকদের জীবনমানও উন্নত। তাই কম মজুরি দিয়ে বা শ্রমিকদের বঞ্চিত রেখে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন যে অসম্ভব, এই সরল সত্য সরকার ও মালিকপক্ষকে বুঝতে হবে। যেকোনো দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন অপরিহার্য।

মহান মে দিবস উপলক্ষে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষকেও জানাই অভিনন্দন।