বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এ দেশের তরুণেরা জীবন দিয়ে মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করলেও আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই। বায়ান্নর পরও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অনেক চক্রান্ত হয়েছে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আরবি হরফে বাংলা লেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমাদের পূর্বসূরি লেখক-শিল্পী-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা সেই চক্রান্ত নস্যাৎ করে বাংলা মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন।
স্বাধীনতার পর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর এর তাৎপর্য আরও বেড়ে যায়। এখন বিশ্বের সব দেশে দিবসটি উদ্যাপিত হচ্ছে। এসব অবশ্যই আনন্দের কথা।
ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল একটি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠারও সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই একাত্তরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তাই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণের পাশাপাশি মাতৃভাষার উন্নয়নে কী করেছি, কী করতে পারিনি, সেসবও গভীরভাবে ভাবতে হবে। ভাষার অগ্রগতি হয় শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে। অথচ স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও জনসংখ্যার বিরাট অংশ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
মনীষীরা মাতৃভাষায় শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন।’ অথচ মাতৃভাষাকে এখনো আমরা সর্বস্তরে শিক্ষার বাহন করতে পারিনি। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসাবিদ্যাসহ উচ্চশিক্ষার অনেক বিষয়ে বাংলায় বই নেই।
ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রাথমিক স্তরে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার যে সুপারিশ করেছিল, অদ্যাবধি তা বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য ভাষার মানুষ আছে, আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চাই; অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ভাষার অধিকারও দিতে হবে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং সেসব ভাষা নিয়ে গবেষণা ও চর্চার যে উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; তা-ও সফল হয়েছে বলা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে অনুবাদ সাহিত্যের ওপর জোর দিয়েছেন। অনুবাদ হতে হবে দুই দিক থেকেই। বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যের সেরা লেখকদের রচনা যেমন বাংলায় অনুবাদ করতে হবে, তেমনি বাংলা ভাষার সেরা লেখকদের রচনাও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগের কথা আমাদের জানা নেই।
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে পালিত ও স্মরিত হয়। কিন্তু যে মাতৃভাষার জন্য তরুণেরা জীবন দিয়েছেন, সেই ভাষার যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া দুঃখজনক। মাতৃভাষার মর্যাদা মানে রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে এর প্রচলন।
একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের পক্ষে জোরালো ভাষায় বক্তৃতা-বিবৃতি দেন। কিন্তু তাঁরা কার্যকর বা টেকসই পদক্ষেপ নেন না। সরকারি কাজকর্মে বাংলা চালু থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, গবেষণাসহ নানা ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রাধান্য লক্ষ করা যায়।
ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই। প্রয়োজন হলে আমরা যেকোনো ভাষা শিখব, কিন্তু মাতৃভাষাকে অগ্রাহ্য করে নয়।
আমরা যদি ভাষাশহীদদের প্রতি সত্যি সত্যি শ্রদ্ধাশীল হই, তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত রাখলে চলবে না, এর মর্ম উপলব্ধি করতে হবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ভাষার উন্নয়নেও কাজ করে যেতে হবে।