দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনা-উত্তাপ ছিল এক বছরের অধিক সময় ধরে। দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অনড় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও জনমনে একধরনের আশা ছিল যে নির্বাচনের বিষয়ে হয়তো দুই পক্ষ শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে আসতে পারবে।
এ ব্যাপারে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ১৪ দলের শরিক ও সদ্য নিবন্ধিত বেশ কিছু দল আজ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরেই থাকল।
কঠিন এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় আজ যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে ধরে নেওয়া হলেও এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় অধিকাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে মূলত আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ানো সেই একই দলের ডামি প্রার্থীদের মধ্যে।
এখানে বিরোধী দল বলে আসলে কিছু নেই। ক্ষমতাসীন দলটি নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর জন্য নৌকা ও স্বতন্ত্র ডামি প্রার্থীর মধ্যে ভোটযুদ্ধ চালানোর যে কৌশল নিয়েছে, তা নির্বাচনী মাঠে সংঘাত-সংঘর্ষও বাড়িয়ে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন স্থানে শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, যাতে কয়েকজনের প্রাণহানি ও বহু মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে যে নির্বাচন হয়ে থাকে, এবারের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি অংশ না নেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তা অনেকটা অনুপস্থিত। একদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো ভোটারদের কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে ভোট বর্জনকারী দলগুলো জনগণের প্রতি ভোটারদের কেন্দ্রে না আসার আহ্বান জানাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হয়। সরকার ও সরকারি দলের মধ্যেই এ নিয়ে আলোচনার কথা শোনা যাচ্ছে।
নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ৬ ও ৭ জানুয়ারি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করেছে। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যেন কোনো ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সহযোগিতা করতে বাধ্য। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের তীব্র প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে শক্ত ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের অর্থ হলো প্রতিনিধি বাছাইয়ের উন্মুক্ত সুযোগ। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনপ্রক্রিয়ার বাইরে থাকায় সেই সুযোগ অনেকটা রহিত হয়ে গেছে। ‘নির্দিষ্ট’ প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার যেসব খবর গণমাধ্যমে এসেছে, সেটি সত্যি হলে সেই প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ আরও কমে যাবে।
এ ধরনের ভোটযুদ্ধে আর যা–ই হোক, জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। নির্বাচন কমিশন দায় এড়াতে চাইলেও একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও তা নিশ্চিত না করে কমিশন ভোটারদের প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে।
আজকের ভোটের মাধ্যমে হয়তো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষা হবে, কিন্তু এমন একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় পড়তে যাচ্ছে, তা দেশকে নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিতে পারে।