উদ্ধারকার্য ও ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় প্রয়োজন

বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী ১২টি জেলার ওপর দিয়ে যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি দেখা গেল, তা নজিরবিহীন। গত তিন দশকে এই অঞ্চলে এ রকম বন্যা আর হয়নি। মৌসুমের শুরু, মধ্য কিংবা শেষে সাধারণত সিলেট অঞ্চল ও উত্তরবঙ্গে একাধিক বন্যা হয়ে থাকে। কিন্তু এবার পূর্ব সীমান্তের ১২টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বন্যা যে তাণ্ডব তৈরি করল, তাতে ১৫ জনের প্রাণহানি ছাড়াও কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। বন্যার তোড়ে বহু ঘরবাড়ি, মাছের খামার, গাছপালা ও শস্য ভেসে যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বহু সড়ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মেরামত করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। 

বন্যার কারণ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা ও সমালোচনা দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছেন আবহাওয়া দপ্তর পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ বলছেন যৌথ নদী কমিশনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে বাংলাদেশ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেনি। কিন্তু এসব কারণ অনুসন্ধান কিংবা ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে পরে ভাবা যাবে। এই মুহূর্তে জরুরি হলো বন্যাদুর্গত মানুষগুলোকে উদ্ধার করা, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ জরুরি বৈঠক করে বন্যা মোকাবিলার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকেও বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা। প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে সহায়তা পাঠানোর কথাও বলা হয়েছে। 

এর পাশাপাশি যে বিষয় আমাদের আশান্বিত করে, সেটি হলো বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সক্রিয় উদ্যোগ। শিক্ষার্থী, বিভিন্ন পেশাজীবী, সাধারণ মানুষ; ধর্মীয়–রাজনৈতিক–সামাজিক সংগঠন দলে দলে দুর্গত মানুষকে সহায়তা করছেন। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণকাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। যেকোনো দুর্যোগে মানুষ মানুষের পাশে ছুটে যায়—এটিই এ দেশের অন্যতম সৌন্দর্যতম বৈশিষ্ট্য। সেটি আমরা এবারের বন্যায় আবারও দেখতে পেলাম।

এখনো অনেক এলাকা পানিবন্দী। গতকাল পর্যন্ত অনেক মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে আনা যায়নি। নৌকায় করে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো হচ্ছে, তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সবার পক্ষে সবখানে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। অনেক জায়গায় বৃষ্টি থামলেও পানি সরে না যাওয়ায় জনদুর্ভোগ প্রলম্বিত হচ্ছে। পানি সরে যাওয়ার জন্য যে খাল, নালা ও জলাশয় প্রয়োজন, সেগুলো আমরা অনেক আগেই ভরাট করে ফেলেছি। সে ক্ষেত্রে পানি সরে যেতে সময় লাগবে।

আকস্মিক বন্যার কারণে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন এক কাপড়ে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের খাবারের পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব এলাকার বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সেসব এলাকায় কীভাবে সংযোগ দেওয়া যায়, তা জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে ও পদক্ষেপ নিতে হবে।

ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হচ্ছে যাঁরা শহর বা বড় সড়কের কাছে থাকেন, তাঁদের কাছেই বেশি ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়। এর ফলে এক এলাকার মানুষ বেশি পান, আরেক এলাকার মানুষ বঞ্চিত থাকেন। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীদের এ বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। দুর্গম এলাকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। আশা করি, প্রশাসন বন্যা মোকাবিলায় সমন্বয়ের কাজটি যথাযথভাবে করবে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী দুর্গত এলাকায় গেছেন উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ কার্যক্রমে, তঁাদেরও নিরাপত্তার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। 

পানি নেমে গেলে হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার দিকে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। বন্যা–পরবর্তী সহায়তা ও পুনর্বাসনের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বন্যা শেষে সবাই নিরাপদে ঘরে ফিরুক, সেটিই আমাদের কামনা।